শিশুর মাঝে পজিটিভ ইমেজ তৈরিতে বাবা-মায়ের কর্তব্যগুলো কি জানেন?
বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে চরম অস্থির এক সময় পার করছে বিশ্ববাসী। প্রতিদিন বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়তি জনসংখ্যার বাসস্থানের জন্য ছাড় দিতে হচ্ছে খেলার মাঠ, পর্যাপ্ত খালি জায়গা। সেইসঙ্গে বাড়ছে কর্মজীবনের পরিধি। এতকিছুর ভিড়ে সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গতায় ভুগছে নতুন প্রজন্মের শিশুরা। স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ, বন্ধুর অভাব আর কর্মজীবী বাবা মায়ের সঙ্গে দূরত্ব—সবমিলিয়ে শিশুর মাঝে পজিটিভ ইমেজ তৈরিতে কিংবা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উপযুক্ত আচরণের মত বিষয়গুলো এখন অনেক বেশি প্রশ্নবিদ্ধ।
সাইকোথেরাপিস্ট ক্রিস্টোফার উইলার্ড তার এক নিবন্ধে শিশুর মানসিকতার ঘাটতির জন্য আঙুল তুলেছেন স্মার্টফোনসহ যাবতীয় সব গেজেটের দিকে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা যত বেশি স্ক্রিনের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ বাড়াচ্ছি, ততটাই নিজেদের উপর থেকে, সেইসঙ্গে নিজের চারপাশ থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলছি।’ শিশুদের মাঝে অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্ক্রিন কখনোই খুব বড় ইস্যু নয়, কিন্তু অতিরিক্ত স্ক্রিনে সময় দেওয়ার কারণে শিশুরা নিজের ভেতরের সকল অনুভূতি সম্পর্কে ভুলে যাচ্ছে। একটা সুন্দর দিন, ক্লাসের শিক্ষকদের বলা কথা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কোনোকিছুই তাদের ভেতর ভালো মুহূর্ত তৈরি করছে না। এমনকি চলার পথে একজন সমবয়সীর সাথে কীভাবে কথা বলা উচিত তাও তারা বুঝতে পারছে না।‘ তবে একদম নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। সাধারণ কিছু চর্চার মাধ্যমে শিশুর মাঝে পজিটিভ ইমেজ তৈরি করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চলুন জেনে নেই এ বিষয়ে-
১) নিজের মাঝে পজিটিভিটি আনুন
কোন সন্দেহ নেই, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। শিশুদের মাঝে যে অভ্যাস গড়ে ওঠে তার প্রায় সবকিছুর জন্য দায়ী শিশুর চারপাশের বড়রাই। বড়রা ফোনের প্রতি যতবেশি মনোযোগ দেয়, শিশুরাও ঠিক ততটাই মনোযোগ দেয়। ক্রিস্টোফার উইলার্ডের মতে, এমন হলে সবার আগে নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা খাবার টেবিলে ফোন থেকে যত বেশি দূরে থাকবো কিংবা যতবেশি নিজের প্রতি সময় দেওয়া শুরু করবো, কিংবা যখনই শিশুদের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারবো, তখন তারাও আমাদের মতোই আচরণ প্রদর্শন শুরু করবে।’
সরাসরি নিষেধের পরিবর্তে তাদের সঙ্গে পজিটিভ আচরণ করতে হবে। যেমন- ‘ফোনটা রেখে দাও‘ এর পরিবর্তে ‘চলো বাইরে যাওয়া যাক কিংবা পার্কে ঘুরে আসা যাক।’ এ ধরণের কথা বলে তাদের মাঝে পজিটিভ চিন্তাধারার বিকাশ ঘটানো যায়।
২) লম্বা শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস
ক্লান্তি দূর করতে ‘লম্বা শ্বাস নিয়ে ধীরে শ্বাস ছাড়া’ এই পদ্ধতিটি বেশ কাজে আসে। এমন অভ্যাস গড়ে তোলা যায় বাচ্চাদের মধ্যেও। লম্বা শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শান্ত হতে সাহায্য করে। শিশুদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি তাদের মস্তিষ্কে ইতিবাচক সাড়া দেয়। ধরা যাক, একটি শিশু কোনো এক কারণে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে আছে। এ সময় তাকে লম্বা দমে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়তে বলুন। এতে তার রাগ বা উত্তেজনা অনেকটা কমে আসবে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দেয়াও অনেক সহজ হবে।
এক্ষেত্রে আরেকটা উপায়, সংখ্যার সাহায্যে শ্বাস প্রশ্বাস ধরে রাখা। যেমন, চার গোণা পর্যন্ত শ্বাস নেয়া, একই সময় পর্যন্ত শ্বাস ধরে রাখা। আবার ঠিক একই সময় নিয়ে শ্বাস ত্যাগ করা। এতে করে গণনা এবং সংখ্যার সঙ্গেও বাচ্চাদের সম্পর্ক বাড়বে।
৩) শিশুকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা
পড়াশোনা, খাবার খাওয়া কিংবা ঘুমাতে যাওয়ার আগের সময়গুলোতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন। তাদের মাথা থেকে স্বাভাবিক ব্যস্ততাকে ছুটি দেওয়ার জন্য ভাবুন কী করা যায়। ক্রিস্টোফার উইলার্ড এক্ষেত্রে কিছু সাধারণ উপায় বাতলে দিয়েছেন। যেমন, সারাদিনে তারা কী কী শব্দ শুনেছে, কিংবা জানালার বাইরে ঠিক কী কী রঙ তাদের চোখে আসছে এসব হালকা প্রশ্ন করা যায়।
এগুলো ছাড়া খুব সাধারণ কিছু শরীরচর্চাও শিশুদের ইন্দ্রিয় অর্থাৎ সিক্স সেন্স অনুভূতির বিকাশে সহায়ক। নিজের হাতে, পায়ে কিংবা মস্তিষ্কের মাঝে তারা কী অনুভব করছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করুন। সহজ কিছু কাজ দিন, যেন প্রয়োজনের সময় নিজেই নিজের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
৪) ধন্যবাদ দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
সারাদিনে যা কিছু হয়েছে তার মাঝ থেকে পজিটিভ কিছু খুঁজে বের করে তার জন্য পরিবারকে ধন্যবাদ দেওয়া, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো নতুন কিছু অভ্যাস তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে খাবারের টেবিল খুব ভালো একটি জায়গা। একসাথে খেতে বসার পর সকলেই সারাদিনে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পজিটিভ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতে পারেন। সেইসঙ্গে এই বিষয়গুলোর জন্য যাদের কাছে আপনি কৃতজ্ঞ তাদের ধন্যবাদ জানান। এর ফলে শিশুর মাঝে শিষ্টাচারের শিক্ষা গড়ে উঠবে।
শিশুদের কাছে প্রশ্ন করুন, সারাদিনে মজার বা ভালো কোন ঘটনা ঘটেছে। কিংবা সারাদিনে তারা সুন্দর কিছু দেখেছে কিনা। এসব ছোট ছোট অভ্যাসের ফলে শিশু নিজের জীবনের বিভিন্ন দিকে নজর দেওয়া শিখবে।
৫) তাদের সঙ্গে যা হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিন
বেশিরভাগ বাচ্চারই ধারণা, তাদের সঙ্গে যা হচ্ছে তা ঠিক নয়। অনেক বাচ্চারই কোনো এক বিষয়ে মনোযোগ দিতে সমস্যা হয় বা স্বাভাবিক কাজের ক্ষেত্রে ক্লান্তি আসে। এক্ষেত্রে তাদের মন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া বা চারপাশে ঠিক কী হচ্ছে সেই ব্যাখ্যা দেওয়া হলে পরিস্থিতি অনেক বেশি সহজ হয়ে যায় তাদের জন্য।
এই ধরণের স্বাভাবিক কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে শিশুদের পরিবেশ সহজ করে তোলা যায়। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির সময়টায় কিশোরদের সঙ্গে এমন চর্চা তাদের মধ্যে বেশ পজিটিভ দিক নিয়ে আসে। এ সময় তাদের ভেতর বাইরে অনেক পরিবর্তনই দেখা যায়। সেসব পরিবর্তন সম্পর্কে তাদের ধারণা দিন। এতে করে শিশু কিশোরদের জীবন নিজেদের কাছে অনেক সহজ হয়ে উঠবে।
শিশুদের মাঝে অল্প বয়স থেকেই এসব চর্চা নিয়মিত করা উচিত। এতে যে কোনো বয়সে যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠবে।