গরমে শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে যা করবেন
বাংলাদেশে শিশু-মৃত্যুর প্রধান কারণ ডায়রিয়া। এতে দরকারি পানি ও লবণ জাতীয় পদার্থ শরীর থেকে বের হয়ে প্রচণ্ড পানি শূন্যতা দেখা দেয়। পায়খানার সাথে শুধু মল ও পানি গেলে তাকে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা বলে। আসুন জেনে নিই এর কারণ,লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে।
ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা কী ?
বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ডায়রিয়া। বার বার পাতলা পায়খানা হওয়াকেই সাধারণভাবে ডায়রিয়া বলে। প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার বা এর চেয়ে বেশি পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলে চিহ্নিত করা হয়। ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পরিমানে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায় এবং শরীরে ভয়াবহ পানি স্বল্পতা দেখা দেয়। ডায়রিয়ার সঙ্গে কখনো কখনো কারও জ্বর, বমি অথবা পেটে ব্যথা হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর স্যালাইন ছাড়া তেমন কোন ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। শুধুমাত্র খাবার স্যালাইনেই ডায়রিয়া ভাল হয়ে যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন প্রকার এন্টিবায়োটিক খাওয়া যাবেনা।
মল বা পায়খানার ধরণ দেখে ডায়রিয়া, কলেরা ও আমাশয় বুঝার কৌশল
ডায়রিয়া ও আমাশয়ের মধ্যে গুরুত্বপুর্ন পার্থক্য হলো পায়খানায় যদি শুধু মল ও পানি থাকে তাহলে তাকে পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া বলে। আর পাতলা পায়খানার সাথে যদি রক্ত আসে তাহলে তাকে আমাশয় বলে। আর শিশুর কলেরা হলে তাঁর পায়খানা চাউল ধোয়া পানির মতো ঘোলাটে হয়ে থাকে। তবে মলের নমুনা পরিক্ষার পরই সঠিকভাবে প্রকৃত রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
ডায়রিয়ার কারণ সমূহ
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় শিশুরা খুব সহজেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। দূষিত খাবার ও পানীয়ের মাধ্যমে ডায়রিয়া বেশী ছড়ায়। গরমের সময় শিশুর ডায়রিয়া মারাত্মক হতে পারে। ডায়রিয়া হলে আক্রান্ত শিশুর শরীর থেকে প্রচুর পরিমানে পানি ও খনিজ লবণ বের হয়ে যায় এবং শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। শিশুর ডায়রিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে– ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস নামক কৃমি ও প্রোটোজোয়া ঘটিত ডায়ারিয়া। অনেক সময় কোন ঔষধের রিয়েকশনের ফলেও ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে আমাদের দেশে গরমের সময় ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত ও ফুড পয়জন জনিত ডায়রিয়া বেশী হয়ে থাকে। নিম্নে বিভিন্ন কারণ সমুহ বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো।
১। ভাইরাস জনিত ডায়রিয়া
আমাদের দেশে গরমের সময় ব্যাপক হারে ডায়রিয়া হওয়ার প্রধান কারণ হলো রোটা নামক একধরনের ভাইরাস। এছাড়া নোরো ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণেও বিশেষ করে নবজাতক শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। এসব ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানার সাথে বমি, পেটে ব্যাথা, জ্বর এবং কাঁপুনি হতে পারে।
২। ব্যাকটেরিয়া জনিত
যে সব ব্যাকটেরিয়া পাতলা পায়খানার জন্য বেশী দায়ী বলে মনে করা হয় সেগুলো হলো – সালমোনেলা (Salmonella, শিগেলা (Shigella flexneri), ব্যাসিলাস (Bacillus cereus) , ইশ্চেরিচিয়া কোলাই (Escherichia coli), ভিব্রিও (Vibrio cholerae )। বাচ্চার যদি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয় তবে তীব্র ডায়রিয়া হতে পারে, সাথে ক্র্যাম্পিং, মলের সাথে রক্ত এবং জ্বর হতে পারে। এক্ষেত্রে বমি হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন নিজে থেকে সেরে যায়। কিন্তু কিছু ইনফেকশন যেমন- ই কোলাই এর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে। তাই যদি বাচ্চার এসব লক্ষণ থাকে তাহলে শিশুকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
৩। পরজীবী জনিত ডায়রিয়া
মলে বসবাস করা বিভিন্ন এন্টামিবা জাতীয় পরজীবীর সংক্রমনেও শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। এর সাথে পেটে গ্যাস, পেট ফুলে যাওয়া এবং তৈলাক্ত মলের লক্ষণ থাকতে পারে। এ ধরনের ডায়রিয়া হলে অবশ্যই বাচ্চাকে অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে হবে।
৪। ডায়রিয়া হওয়ার অন্যান্য কারণ
ওষুধের কারনেও যেমন অ্যান্টিবায়োটিকের কোন কোর্সের মাঝে বা পরে বাচ্চার ডায়রিয়া হতে পারে। এমন হলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে আলাপ করুন, তবে কোনভাবেই ডাক্তারের দেয়া এন্টিবায়োটিক বন্ধ করা যাবেনা। অতিরিক্ত জুস পান করলেও বাচ্চার ডায়রিয়া হতে পারে। এছারাও বাচ্চার ফর্মুলা দুধ তৈরিতে পানি এবং ফর্মুলার মিশ্রণে তারতম্য থাকলেও ডায়রিয়া হতে পারে। তাই ফর্মুলাতে যাতে সঠিক পরিমানে পানি মেশানো হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শিশুর ডায়রিয়ার প্রতিকারের উপায়
যদি শিশুর পাতলা পায়খানা শুরু হলে তার শরীর থেকে যে পরিমাণ তরল বের হয়ে যাচ্ছে সেটার অভাব পূরণ করা দরকার। তা না হলে তার শরীরে মারাত্মক পানিশূন্যতা তৈরি হবে ৷ তাই কোলের শিশুকে বার বার বুকের দুধ খেতে দিন এবং যতবার সে চাইবে ততবারই তাকে খাওয়ান ৷ যদি বাচ্চার বয়স ৬ মাসের বেশি হয়, বুকের দুধ খাওয়ানো সহ তাকে অল্প অল্প করে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ (ফুটিয়ে ঠান্ডা করা)পানি খাইয়ে দিন ৷ এছাড়া তাকে অন্যান্য স্বাভাবিক খাবারও খেতে দিতে হবে। এছাড়া তাকে প্রতি ঘন্টায় কয়েকবার চুমুক দিয়ে ওরাল স্যালাইন (ওআরএস) খাওয়ানোর চেষ্টা করুন৷ স্যলাইন তৈরী করে ৮-১২ ঘন্টার মধ্যে তা ব্যবহার করতে হবে। প্রত্যেকবার পাতলা পায়খানার পরে আপনার শিশুকে ১৫-২০ চা-চামচ ওআরএস খেতে দিন৷ যদি আপনার শিশু ওআরএস না খেতে চায়, তাহলে আপনি লবন চিনি দিয়ে লেবুর পানি, ডাল বা ভাতের মাড় বা ডাবের পানি দিতে পারেন৷
এই গরমে ডায়রিয়া প্রতিরোধের উপায়সমূহ
একটু সাবধান হলে এই গরমে খুব সহজেই শিশুসহ বড়দেরও ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমনঃ
- গরমে শিশুরা প্রচুর ঘামে তাই তাদের অনেক বেশি পানি পিপাসা লাগে। তাই তাদের পানি ভালভাবে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করতে দিন এবং নিজেরাও বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
- গরমে খাবার বেশিক্ষণ ভাল থাকে না। তাই অসাবধানতাবশত কখনও শিশুকে পচা অথবা বাসি খাবার খাওয়াবেন না।
- ·গরমে ডায়রিয়ার জন্য দায়ী বিভিন্ন রোগজীবাণু যেমন ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, ও গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস নামক পরজীবী কৃমির বংশবৃদ্ধি অনেক বেশি হয়। তাই আপনার ঘরকে অবশ্যই সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।
- গরমের সময় শিশুকে বেশি বেশি খাওয়ার স্যালাইন ও তরল খাবার, যেমন- ভাতের মাড়, ডাবের পানি, ঘোল, টকদই, ফলের রস ও লবণ-গুড়ের শরবত খেতে দিতে পারেন। মনে রাখবেন স্যালাইনের কাজ ডায়রিয়া বন্ধ করা নয়। এটি শুধুমাত্র শরীরের পানি ও লবণের শূন্যতা পূরণ করে।
- প্রতিবার পায়খানার পর ১০ থেকে ১৫ চামচ খাবার স্যালাইন আপনার শিশুকে খেতে দিন। অবশ্যই মনে রাখবেন, স্যালাইন ধীরে ধীরে খাওয়াতে হবে এবং এক এক চামচ করে সময় নিয়ে খাওয়াতে হবে।
- শিশুকে অন্যান্য খাবার সঠিকভাবে দিতে হবে। সব রকমের খাবার, যেমন- খিচুড়ি, মাছ, মাংস, ডাল, ভাত, ডিম, কলা, ফলের রস, সবজি ইত্যাদি সবকিছুই শিশু খেতে পারবে।
- খাবার রান্না করার সময় অবশ্যই সয়াবিন তেল দিবেন। কাঁচকলা ডায়রিয়ার তীব্রতা কমায় ও তাজা ফলের রস পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণে সহায়ক। তাই তাদের এসব খাবার খেতে দিন।
ডায়রিয়া চিকিৎসা করার সব থেকে গুরত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পানিশূন্যতা হতে না দেয়া। যার মানে পায়খানার মাধ্যমে বের হয়ে যাওয়া পানি ও লবণের সময়মত প্রতিস্থাপন করা খুবই জরুরী। ডায়রিয়ার কারণে যেহেতু প্রয়োজনীয় পানি ও লবণ (যার মধ্যে রয়েছে চিনি, সোডিয়াম,পটাশিয়াম) শরীর থেকে বের হয়ে যায় আর তা শুধু পানিতে পাওয়া যায়না। সেজন্য ডায়রিয়ার রোগীকে যেই সব তরলে এইসবের মাত্রা বেশী থাকে যেমন ওরাল স্যালাইন, ডাবের পানি ইত্যাদি বেশী বেশী খেতে দিন
Source: daktarbhai