গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড থাকলে তা আপনার বাচ্চার ওপরে কিভাবে প্রভাব ফেলে?

থাইরয়েড একটি ছোট গ্রন্থি যা মানুষের গলার সামনের দিকে চামড়ার নিচে থাকে। এ গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়ে রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে যায়। থাইরয়েড হরমোন শরীরের অনেক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ সহ কিভাবে দ্রুত আপনার ক্যালোরি বার্ন এবং কত দ্রুত আপনার হৃদয়স্পন্দন হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছারাও এ হরমোন মানব দেহে শক্তি উৎপাদন করে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। গর্ভাবস্থায় থাইরয়েডের সমস্যা হতে পারে। এ হরমোন স্বাভাবিক পরিমানের চেয়ে বেশি বা কম নিঃসরনের কারণে বিভিন্ন রকমের থাইরয়েড রোগ দেখা দেয়। বেশী নিঃসরন এর কারণে যে রোগ তাকে হাইপারথাইরয়ডিজম এবং কম নিঃসরন এর কারণে রোগকে হাইপোথাইরয়ডিজম বলে।

থাইরয়েড সম্পর্কে বিস্তারিত

গর্ভাবস্থায় থাইরয়েডের সমস্যা সম্পর্কে জেনে রাখা খুব জরুরি কারণ আপনি হয়তো অনেক সময় এমন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন যে বুঝতে পারেন না যে সমস্যা টা কেন হচ্ছে।

গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড কিভাবে প্রভাবিত করে?

গর্ভাবস্থায় মায়েদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের চাহিদা বেড়ে যায়। গরভকালীন এইচসিজি হরমোন এবং এস্ট্রোজেন থাইরয়েড গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে যাতে থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন করে। গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি সামান্য বড় হয়ে যেতে পারে যদিও তা বাইরে থেকে খুব বেশী একটা বোঝা যায়না।

গর্ভাবস্থায় থাইরয়েডের দু ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে-

  • ১. হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েডের লঘূক্রিয়া
  • ২. হাইপারথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েডের অতিক্রিয়া

হাইপোথাইরয়েড লক্ষন

হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষনগুলো সাধারণত মৃদু হয়। এ লক্ষনগুলো ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং অনেকদিন বোঝা যায় না যে আপনার এ সমস্যা আছে। হাইপোথাইরয়েডিজমের প্রধান লক্ষন গুলো হল:

যেসব গর্ভবতী মায়েদের নিকট আত্মীয় কারো থাইরয়েডের সমস্যা আছে (মা বা বোন) তাদের গর্ভধারণের আগেই বা গর্ভধারণের পরপরই থাইরয়েডের পরীক্ষা করে দেখা উচিত।

হাইপারথাইরয়েডিজমের লক্ষন

হাইপারথাইরয়েডিজম থাকলে নিচের লক্ষনগুলো দেখা দিতে পারে। তবে সবগুলো লক্ষন দেখা যাবে এমনটা নয়।

হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম কি গর্ভের বাচ্চার উপর প্রভাব ফেলে?

গর্ভধারণের প্রথম ১২ সপ্তাহে ভ্রুনের বৃদ্ধি নির্ভর করে মায়ের থাইরয়েড হরমোনের উপর। তাই মায়ের পর্যাপ্ত পরিমানে থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ হরমোনের গর্ভের শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই থাইরয়েডের সমস্যা নির্ণয় করা উচিত গর্ভধারণের আগেই বা গর্ভধারণের শুরুতেই। যদি শুরুতেই এ সমস্যা নির্ণয় করা যায় এবং তার প্রতিকার করা হয় তবে গর্ভের শিশুর ঝুঁকির সম্ভাবনা কম থাকে।

  • ১. হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। এ সমস্যার ফলে গর্ভের বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হয় যার ফলে বাচ্চা কম IQ নিয়ে জন্মাতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজমের সঠিক প্রতিকার না হলে আরও কিছু সমস্যা, যেমন- গর্ভপাত, সময়ের আগেই প্রসব, প্রি-এক্লাম্পশিয়া, মৃত সন্তান প্রসব ইত্যাদি হতে পারে। তবে এ সমস্যাগুলো উপযুক্ত চিকিৎসার মাদ্ধমে রোধ করা যেতে পারে।
  • ২. হাইপারথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রেও যদি তা নিরাময় করা না হয় তবে গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন- গর্ভপাত, প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন, প্রি-ম্যাচিউর লেবার ও বার্থ, প্রি-এক্লাম্পশিয়া, মৃত সন্তান প্রসব, কম ওজনের বাচ্চার জন্মদান, এবং গর্ভে বাচ্চার ওজন ঠিক ভাবে না বাড়া ইত্যাদি।
  • ৩. এছাড়াও হাইপারথাইরয়েডিজমের প্রতিকার করা না হলে “থাইরয়েড স্টর্ম” নামের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যদি গর্ভাবস্থায় এর সম্ভাবনা কম। এটি খুব কমন কোন ঘটনা নয় এবং সাধারণত বৃদ্ধ বয়সে হয়। “থাইরয়েড স্টর্ম” বলতে বুঝায় হঠাৎ করে অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরী হয়ে যাওয়া। এর ফলে প্রচন্ড জ্বর, মাথা কাজ না করা, পেটে ব্যাথা, উচ্চরক্তচাপ, হার্ট বিট অত্যন্ত বেড়ে যাওয়া এবং হার্ট ফেইলিওর হয়। তাদক্ষনিক চিকিৎসা না করলে “থাইরয়েড স্টর্ম” জীবন ঘাতি হতে পারে। সাধারণত ইনফেকশন ও স্ট্রেস হাইপারথাইরয়েডিজমের রোগীর মধ্যে “থাইরয়েড স্টর্ম” তৈরী হয়।
  • ৪. অনেক সময় গর্ভাবস্থার উপসর্গগুলি থাইরয়েডজনিত উপসর্গগুলিকে ঢেকে দেয়। যেমন- অনেক মহিলাই গর্ভবতী অবস্থায় ক্লান্ত বোধ করেন। এ উপসর্গ কিন্তু হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণেও হতে পারে। আবার অনেক সময় সন্তান সম্ভবা মায়ের গরমে একটা হাঁসফাঁসানির অবস্থা হয়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এগুলোও কিন্তু হাইপার-থাইরয়েডিজমের উপসর্গ হওয়া সম্ভব। মায়ের হাইপোথাইরয়েডিজম পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেলে মায়ের বা সন্তানের কোনও ঝুঁকি থাকার কথা নয়, স্বাভাবিক গতিতেই গর্ভাবস্থা চলতে দেয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, মায়ের হাইপারথাইরয়েডিজম আয়ত্তের বাইরে চলে যাবার উপক্রম হয়, সে ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ মাসের মধ্যে থাইরয়েড গ্রন্থির অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে। ডেলিভারির সময় শিশুটির থাইরয়েড স্বাভাবিক, অতিমাত্রায় কার্যকর বা অল্প কার্যকরী এই তিনটির যে কোনো একটি হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ শিশুটির চিকিৎসা শুরু করা হয়। এ কারণে বলা হয়, থাইরয়েডে আক্রান্ত মায়ের ডেলিভারি অবশ্যই কোনো বড় হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানে হওয়া উচিত যেখানে মা ও শিশুর আধুনিক চিকিৎসার সবরকম ব্যবস্থা আছে।
  • ৫. হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসাধীন মা অবশ্যই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সর্বদাই মাথায় রাখেন যে ওষুধের সামান্য অংশ বুকের দুধের মধ্য দিয়ে বের হয় কাজেই শিশুটিকে বিশেষভাবে নজরে রাখতে হয়। যদি কোনো ভাবে তার মধ্যে থাইরয়েডের অসুখের সামান্যতম চিহ্নও দেখা যায় তার যথাযথ চিকিৎসা দরকার। যেসব মাকে এলট্রকসিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয় তাঁদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিডিং- এর কোনো অসুবিধা নেই।
  • ৬. কোনো কোনো মা ডেলিভারির তিন মাস পরে থাইরয়েডের প্রদাহে ভুগতে পারেন- তাকে বলে পোস্ট পারটাম থাইরয়েডাইটিস। প্রথমে একটা অস্থায়ী হাইপোথাইরয়েডিজম হয় তারপর ধীরে ধীরে হাইপারথাইরয়েডিজম । এ ধরনের অসুখেরও যথাযথ চিকিৎসা আছে, তবে রোগের সঠিক ডায়াগনোসিস হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
  • ৭. উন্নত দেশগুলোতে, শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর নাভি সংলগ্ন নাড়ি থেকে রক্ত নিয়ে কয়েকটি পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষা করলে নিশ্চিতভাবে জন্মগত থাইরয়েডের অসুখ ধরা পড়বে।যদি মায়ের আগে থেকেই থাইরয়েডের সমস্যা থাকে তবে গর্ভধারণের পর তা ডাক্তারকে জানানো উচিত। কারন আপনার অবস্থার উপর নির্ভর করে ওষুধের পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে।

থাইরয়েড প্রতিরোধ করতে যা যা করতে হবে তা

গর্ভাবস্থায় থাইরয়েডের সমস্যা হলে ওষুধের মাত্রার কিছু পরিবর্তন দরকার পড়ে এবং থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতার পরীক্ষা প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার করে দেখা বিশেষ জরুরি। তাই প্রতিটি খেপে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখা ভুলবেন না এবং ওষুধ থেকে শুরু করে যা যা প্রয়োজন কোনটা এড়িয়ে যাবেননা। মনে রাখবেন এই সমস্যা গর্বপাতের কারণ হতে পারে, তাই আপনার সুস্থতাই আপনার শিশুকে বাঁচাতে পারে।

Source:tinystep

Sharing is caring!

Comments are closed.