শিশুর বেড়ে ওঠা । অষ্টম মাস
হামাগুড়িঃ
বাচ্চারা সাধারণত হাত দিয়ে নিজেকে সামনের দিকে আগাতে শেখে, তারপর হাত আর হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করে। তারপর, সেই ভঙ্গিতে সামনে আগানোর, এবং পেছানোর প্র্যাকটিস শুরু করতে পারে। হামগুড়ির ভঙ্গি করতে শেখার পরও অনেক বাচ্চা হামাগুড়ি দেয় না, কিংবা দিতে পছন্দ করে না। অনেকে আবার হামাগুড়ি না দিয়ে হাত বুক আর পেটের উপর ভর করে চলাচল করতে পছন্দ করে। যেভাবেই হোক, ক্রিপিং কিংবা হামাগুড়ি শুরু করলে বাচ্চার হাত ও পায়ের পেশিগুলো আরো মজবুত ও কর্মক্ষম হয় যা পরবর্তিতে বাচ্চার হাঁটতে শেখার ক্ষমতাকে ত্বরান্বিত করে।
সর্বাধিক নিরাপত্তা-বলয় তৈরী ও সার্বক্ষনিক নজরদারিঃ
এসময়টিতে ঘরের আসবাব-পত্রের অবস্থানের দিকে লক্ষ্য করা প্রয়োজন। বিছানা বা টেবিল-চেয়ারের কোণা, টিভি স্ট্যান্ড এবং যেকোনো কোণা বিশিষ্ট জিনিসে বাচ্চা আঘাত পেতে পারে। এসময় বাচ্চা হামাগুড়ির ভঙ্গি থেকে মাথা তুলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারে , এবং শক্ত উঁচু কিছু ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এসময় বাচ্চা যে রুমে থাকে, সেখানে আসবাবপত্র যত কম রাখা যায় মঙ্গল, আর আসবাবপত্র যেন নিরাপদ হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আজকাল চাইল্ড সেইফটির বিভিন্ন উপকরন পাওয়া যায় , যেমন ড্রয়ার/কেবিনেট লকার, ফোমি কুশন যেগুলো আসবাবের কোনায় লাগিয়ে দেয়া হয়, ডোর জ্যামার (যেন হঠাত দরজা বন্ধ হয়ে যায়) এবং ক্রলিং ম্যাট জাতীয় জিনিস এসময় খুব কাজে লাগে।
অনেকে এ বয়সে বাচ্চাকে ওয়াকার নামক গোলাকার একটি জিনিসে বসানোর অভ্যাস করেন, যা মূলত বাচ্চার বেড়ে ওঠার জন্য অপ্রয়োজনীয় একটি জিনিস। এটি তেমন নিরাপদ নয়, এবং খেলা, হামাগুড়ি কিংবা হাঁটার প্র্যাকটিসের জন্য মেঝেই সবচেয়ে উপযুক্ত। তাই নিয়মিত ঘরের মেজে পরিস্কার রাখতে হয়, এবং সবচেয়ে ভালো হয়, পাটি, পাতলা কার্পেট কিংবা ম্যাট জাতীয় কিছু বিছিয়ে মেঝেতেই বাচ্চাকে খেলতে দিলে। বাচ্চাকে প্লাস্টিকের টুল বা নিরাপদ কোন কিছু ঠেলে বা ভর দিয়ে হাটা শেখানো প্র্যাকটিস করাতে পারে, হতে পারে, কোন টুল কিংবা পুশিং কোন টয়।
এসময় থেকে সামনের কয়েক বছর পর্যন্ত, ইলেকট্রিকের জিনিস, চার্জার, কেবল, সকেট এবং ড্রয়ার, যেকোনো ক্যামিক্যাল বা ওষুধ জাতীয় জিনিস, গরম কিছু, ধারালো কিছু, ছোট জিনিস যেমন বোতাম, পয়সা ইত্যাদি বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। এগুলো কোনোভাবেই বাচ্চার হাতের নাগালের ভেতর রাখা উচিত নয়। বাথরুম ও রান্নাঘর যখন ব্যাবহার করা হয়না, তখন এগুলোর দরজা যেন অবশ্যই লকড থাকে। ঘরে বা বারান্দায় কোন টব বা গাছ থাকলে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন, অনেক পাতাবাহার গাছ বিষাক্ত হয়ে থাকে। সিঁড়ি থাকলে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যাবস্থা নিন।
এই বয়সী বাচ্চার জন্য সব ধরণের নিরাপত্তার বিষয়গুলো লিস্ট-এ উল্লেখ করা সম্ভব না সত্যি কথা বলতে। তাই সার্বক্ষণিক নজরদারী খুবই জরুরী।
দাঁত ওঠা
এসময় কিছু বাচ্চার ছোট্ট নতুন এক দুইটি দাঁতের দেখা মিলতে পারে। অনেক বাচ্চার আরও আগেই দাঁত উঠে যেতে পারে। আবার কারো কারো দাঁত উঠতে ১২ থেকে ১৬ মাস লেগে যায়। এর যেকোনোটিই স্বাভাবিক। দাঁত না উঠলেও এসময় বাচ্চার মাড়ি শক্ত হবে, এবং এটা ওটা মুখে দেয়া এবং কামড়ানোর অভ্যাসটি বলবত থাকবে। সুতরাং কামড়ানোর উপযোগী নিরাপদ ও পরিষ্কার খেলনা রাখুন শিশুর আশেপাশে। এ বিষয়ে আগের মাসের আলোচনায় বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
কর্মকাণ্ড ও মানসিক বিকাশঃ
এই বয়সের বাচ্চারা কোন কিছু ঝাঁকিয়ে দেখতে, নেড়েচেড়ে দেখতে পছন্দ করবে, রঙিন জিনিসের প্রতি আকর্ষিত হবে এবং এটা ওটা ছুঁড়ে দিয়ে মধ্যাকর্ষন ও সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন শব্দের উৎস নিয়ে তার নিজস্ব গবেষণা চালাতে থাকবে। এসময় আপনার সাধের কোন ভঙ্গুর জিনিস এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর হাতের কাছে না রাখাই শ্রেয়। তাকে শব্দযুক্ত খেলনা দিন, কোনকিছু ছুঁড়ে ফেললে সে আশা করবে আপনি তা কুড়িয়ে এনে দেবেন। সুতরাং আগামী কিছুদিনের জন্য আপনাকে তার ছুঁড়ে ফেলা বস্তু কুড়িয়ে বেড়াতে হবে- বাচ্চার মানসিক বিকাশের জন্য বাচ্চার সাথে খেলায় এই ইনভল্ভমেন্টগুলো খুব প্রয়োজনীয়। তাকে রঙিন বই পরে শোনান, বিশেষ করে বড় বড় ছবি-ওয়ালা বই। তবে তার হাতে দিলে সে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, কিংবা বইয়ের পাতা মুখে দিতে পারে, তাই খেয়াল রাখতে হবে। বয়সপযোগী বোর্ড বই পাওয়া যাচ্ছে এখন, এগুলো ছেঁড়া খুব সহজ হয় না।
বাচ্চার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলুন। তার শব্দভাণ্ডার এখন খুবই কম- বুব্বু, দো-দো, তাত্তা-দাদা-মাম-মাম ইত্যাদি পর্যন্তই । তাই বলে, আপনাকে তার অনুকরণে কথা বলতে হবে না, আপনি আপনার সাধারণ টোনেই কথা বলুন। আপনার কথার উত্তর আপনার মতো করে দিতে না পারলেও, আপনার ভাষা বুঝতে শিখবে এবং নিজেকে আপনার কথা বলার উপযোগী একজন মনে করে বিশেষ পুলকিত হবে। তার সাথে কথা বলতে কোন আলাদা সময় বের করার প্রয়োজন নেই, তাকে খাওয়ানোর সময়, গোসল করানো কিংবা ন্যাপী চেঞ্জের সময় কথা বলুন। গান কিংবা ছড়াও পছন্দ করবে খুব।
আট মাসে বাচ্চারা সাধারণত বসতে শিখে যায়, এর মধ্যে কিছু বাচ্চা কোন সাহায্য ছাড়াই বসতে শেখে। তবে অনেক বাচ্চাই সাপোর্ট ছাড়া সোজা হয়ে বসতে পারে না। এতে চিন্তার কিছু নেই। সাধারণত ১০ থেকে ১১ মাসের মধ্যেই তারা পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রনে বসতে পারে। এসময় থেকে আস্তে আস্তে বাচ্চাকে নিজে নিজে খাবার খেতে অভ্যস্ত করা শুরু করুন, ক্ষুদার্ত অবস্থায় তাকে খাবার দিয়ে বসিয়ে দিন, ব্যাবহার করতে পারেন বূস্টার সিট কিংবা হাই চেয়ার। খাবার বাটি, যেখানে খাবে সে জায়গাটি এবং বাচ্চার দুই হাত ভালো ভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করা নিশ্চিত করুন। এসময় বাচ্চা নিজের শরীরে, খাবার জায়গায় কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলবে, কিন্ত, সে ভয়ে বাচ্চাকে নিজে খেতে দেয়ার প্র্যাকটিসটি বন্ধ না করাই শ্রেয়।
বাচ্চা যেহেতু একটু একটু হাঁটার চেষ্টা করবে , তাকে শক্ত সোলের স্যান্ডেল না জুতা পরানো উচিৎ হবে না। গ্রিপ-ওয়ালা মোজা, কিংবা নরম সোলের জুতা পরাতে পারেন। নতুবা, খালি পা-ই ভালো।
কোন কারণে বাচ্চা ভয় পেলে, কিংবা মন খারাপ বা মেজাজ খারাপ করলে যথাসম্ভব তাকে আদর ও স্নেহ দিন। কোলে নিন, জড়িয়ে ধরুন, এবং যে বিষয়টি সে পছন্দ করছে না, তার থেকে মনঃসংযোগ অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করুন। এ বয়স থেকে বাচ্চারা বাইরে যাওয়া এবং ঘুরে বেড়ানোর মজা একটু একটু করে আবিষ্কার করতে শুরু করে।
আপনি যে সব জিনিসপত্র ব্যবহার করেন বাচ্চা এখন সেগুলোতে আগ্রহ দেখাবে। আস্তে আস্তে সে জিনিস ঠিকমত ব্যবহার করতে শুরু করবে। আপনি হয়তো দেখবে্ন সে নিজের চুল আঁচড়াতে বা কাপ থেকে পানি খেতে চেষ্টা করছে।
বাচ্চার দৃষ্টি এখন অনেক পরিষ্কার হয়েছে। সে প্রায় আপনার মতই দেখতে পায়। এখন সে ঘরের অন্য দিকে থাকা লোকজন বা জিনিস চিনতে পারে। সে হয়তো ঘরের অন্য দিকে একটা খেলনা দেখে সেটার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তার চোখের রং প্রায় শেষ পর্যন্ত যা হবে সেই রকম হয়ে এসেছে, অবশ্য পরে ছোটখাট পরিবর্তন চোখে পড়তেও পারে।
শিশুর সঙ্গে খেতে বসা
আপনার শিশুর যখন ৬ মাস বয়স হয়ে যায় তখন থেকে তার সলিড খাবার খাওয়া দরকার৷ তবে তখনো তার বুকের দুধ খাওয়া দরকার৷ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার শিশুর আরো বেশি করে এবং আরো নানা ধরণের খাবার খাওয়া দরকার। তবে ছোট শিশুরা খাওয়া নিয়ে বায়না করতে পারে এবং সহজেই হয়ত তাদের খাবারে অনীহা হয়ে যায়৷
আপনার শিশু যাতে ভালো করে খাওয়াদাওয়া করে তা সুনিশ্চিত করার জন্য কয়েকটা টিপস:
তাকে প্রচুর পরিমাণে সুস্বাদু খাবার খেতে দিন৷ হাতে সময় নিয়ে বসুন৷ যখন সে খাবে তখন ওর কাছে বসুন, ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ খাওয়াটা ওর জন্য একটা নতুন দক্ষতা, ও এখনো সেটা আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে৷
যদি আপনার শিশু খেতে না চায় তাহলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন৷ তাকে জোর করে খাওয়াবেন না৷ তাকে চিনি, চিপস, ভাজাভুজি বা অন্য অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে দেবেন না৷ ঐসবে কোনো খাদ্যগুণ নেই, এবং আপনার শিশুর জন্য ক্ষতিকর৷
তাকে রং, স্বাদ ও সুগন্ধযুক্ত নানা রকমের খাবার খেতে দিন৷ শিশু বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে প্রায়ই তার রুচিতে পরিবর্তন হয়৷ আপনার শিশু যে খাবার আজকে খেতে চাইছে না সেটাই হয়ত কয়েক সপ্তাহ পরে ওর প্রিয় খাবার হয়ে যায়!
খাবারের সময়টা মজাদার করে তুলুন৷ লক্ষ্য রাখুন সে যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং আপনাদের দুজনের জন্য খাবারের সময়টা আনন্দময় হয়ে ওঠে৷ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, হেসে, কথা বলুন৷ তার খাবারের সময়টা যেন পরস্পর মেলামেশার একটা সময় হয়৷ তাতে তার খেতে সুবিধা হবে, তাছাড়া এইভাবে ওর সামাজিক দক্ষতা এবং নতুন শব্দ শেখা হবে৷
খেতে বসে যদি আপনার শিশু সহজেই অন্যমনস্ক হয়ে যায় তাহলে ওকে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে নিয়ে যান এবং মৃদুভাবে ওকে খেতে উৎসাহিত করুন৷
শিশুর মাইলস্টোনঃ অষ্টম মাস
- হামাগুড়ি দিবে, নিজে নিজে বসতে শিখবে
- দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে এবং সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতে পারবে।
- কোন জিনিষ হতবদল করতে পারবে।
- হাত থেকে কিছু পড়ে গেলে তা খোজার চেষ্টা করবে।
- হাত থেকে খেলনা নিয়ে নিলে প্রতিবাদ জানাবে।
- খেলনা নাগালের বাইরে থাকলে তার কাছে পৌঁছানর চেষ্টা করবে।
- দু আঙ্গুলের সাহাজ্জে কিছু তুলতে পারবে।
- ছোট ছোট শব্দ বলার চেস্টা করবে যেমন দাদা, বাবা, মা ।
- নিজের মতামত দিতে চেস্টা করবে- যেমন কি চায় বা কি চায় না ।
- নিজে নিজে খাবার খাওয়ার চেস্টা করবে।
- বড়দের অনুকরণ করতে শিখবে যেমন: মোবাইলে কথা বলা বা চিরুনি দিয়ে মাথা আচঁড়ানো।
বিপদচিহ্ন
- জড়সড় বা নিস্তেজ থাকা।
- চলন্ত কিছুর দিকে দৃস্টি না দেয়া।
- মাথার ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারা
- কারও দিকে তাকিয়ে না হাঁসা।
- আকর্ষনীয়কিছু দেখলে আগ্রহী না হওয়া
- কোন ধরনের শব্দ না করা
- দাঁর করিয়ে দিলে পায়ে ভর দিতে না পারা।
- কোন কিছু হাত দিয়ে মুখের কাছে আনতে না পারা
- যিনি সর্বাধিক যত্ন নেন (খাবার খেতে দেন) তার প্রতি কোন আগ্রহ না দেখানো
- কোন শব্দে প্রতিক্রিয়া না দেখানো।
- কোন দিকে গড়াগড়ি দিতে না পারা।
- কোন কিছু মতামত দিতে না পারা যেমন পছন্দ বা অপছন্দ
এ সময় কি কি মাইলস্টোন আপনার শিশু অর্জন করতে যাচ্ছে তা জানার সাথে সাথে ভুলে যাবেন না যে এট শুধু মাত্র একটা গাইডলাইন। প্রতিটি শিশুই ইউনিক ( স্বকীয় ) এবং তার বেড়ে ওঠার গতিও ভিন্ন।যে শিশুটি অন্যদের থেকে প্রথমে বসতে শিখেছে সে হয়ত সবার শেষে হামাগুড়ি দিতে শিখবে। অথবা ১৮ মাস বয়সী যে শিশুটি শব্দ ও অঙ্গাভঙ্গির মাধ্যমে এখনো ভাবের আদান প্রদান করছে সে হটাৎ করেই দুই বছর বয়সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্য বলা শুরু করতে পারে।এই টাইমলাইন সিরিজ যেন আপনার কোন রকম দুঃশ্চিন্তার কারন না হয় খেয়াল রাখবেন। প্রতিটি টাইমলাইনকে একটি গাইড হিসেবে ধরে নিতে হবে ।নবজাতক এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
Source: fairy land