গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা । কখন স্বাভাবিক, কখন নয়
গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা সমস্যায় অনেকেই ভোগেন। এই সময় ছোটখাট ব্যথা, যে কোনও সমস্যাতেই উত্কণ্ঠায় ভুগতে থাকেন হবু মায়েরা। এই সময়ে বেশ কিছু কারণের জন্য পেটে ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ এসময়ে নারীদের দেহের অনেক অঙ্গের মাঝে পরিবর্তন ঘটে, জরায়ু আকারে বড় হয়ে যায়, লিগামেন্ট টান টান হয়ে যায়।
বাচ্চার ওজন বহন করার কারনে এ সময় মায়েদের শরীরের পেশী, জয়েন্ট এবং শিরার উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যার কারণে পাকস্থলীর আশপাশের জায়গাগুলোতে অস্বস্তি বোধ হয়। তবে তাই বলে সব ব্যাথাকেই স্বাভাবিক ভাবা উচিত নয়। যখন পেটে ব্যথা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন অবশ্যই চিন্তার কারণ রয়েছে ও সেক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তাই এ সম্পর্কে সচেতনতা জরুরী যাতে গর্ভাবস্থায় পেট ব্যাথার সম্ভাব্য কারণ ও লক্ষণগুলো সম্পর্কে ধারনা থাকে এবং ভয়ের কোন কারণ থাকলে দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়া যায়।
গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হলে কখন সাবধান থাকতে হবে
গর্ভাবস্থায় মাঝে মাঝে পেটে ব্যাথা হওয়া স্বাভাবিক এবং ভয়ের কারণ না হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা মারাত্মক কোন অবস্থার নির্দেশ করতে পারে। ব্যাথা যদি বেশী এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে তা কখনই উপেক্ষা করা উচিত নয়। যদি কিছুক্ষন বিস্রাম নেয়ার পর ব্যাথা চলে না যায় এবং এর সাথে নিচের উপসর্গগুলো দেখা যায় তবে অবশ্যই ডাক্তারকে জানাতে হবে-
- যোনিপথে স্পটিং বা রক্তপাত
- যোনিপথে অস্বাভাবিক তরল নির্গত হওয়া
- শরীরে জ্বর বা কাঁপুনি
- মাথা হালকা লাগা
- প্রস্রাবের সময় ব্যাথা বা অস্বস্তি
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হওয়ার স্বাভাবিক কারণগুলো কি কি?
কিছু কিছু কারণে গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হওয়া স্বাভাবিক। এগুলোর কারণে মায়ের বা গর্ভের শিশুর কোন ক্ষতি হয়না। এগুলো হোল-
পেটে গ্যাস
গর্ভাবস্থায় গ্যাসের সমস্যা বেশী হওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। প্রোজেস্টেরন হরমোনের কারণে মায়েদের শরীরের পেশীগুলো শিথীল হয়ে পড়ে। যেহেতু পরিপাকতন্ত্রের পেশিগুলোও শিথীল হয়ে পড়ে, ফলে মায়েদের খাবার হজম ধীরে হয়। এর ফলে শরীরে গ্যাস সহজে বাড়তে থাকে এবং ঢেঁকুর বা বায়ু ত্যাগের মাধ্যমে বেড়িয়ে আসে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে যখন বর্ধিত জরায়ু অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটিতে চাপ সৃষ্টি করে তখন এ সমস্যা আরও বাড়তে পারে। এসময় বাড়তি গ্যাসের কারণে গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য
গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন এবং গর্ভজাত শিশুসহ জরায়ুর বৃহদন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টির কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে যার কারণেও পেট ব্যাথার উপসর্গ তৈরি হতে পারে।
রাউন্ড লিগামেন্ট পেইন
মেয়েদের পেলভিসে একজোড়া লিগামেন্ট থাকে যা রাউন্ড লিগামেন্ট নামে পরিচিত। এগুলোর কাজ হোল জরায়ুকে সঠিক স্থানে ধরে রাখা। গর্ভধারণের আগে এ লিগামেন্টগুলো পুরু এবং ছোট থাকে। গর্ভধারণের পড়ে জরায়ুর আকার বাড়ার সাথে সাথে এ লিগামেন্টগুলো রাবার ব্যান্ডের মত প্রসারিত হয় এবং পাতলা হয়ে যায়। এ কারণে গর্ভাবস্থায় লিগামেন্টগুলো টান টান অবস্থায় থাকে এবং এতে হঠাৎ কোন চাপ পড়লে ব্যাথা অনুভূত হতে পারে।
গর্ভবতী মায়েরা যখন হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন করেন তখন সাধারণত রাউন্ড লিগামেন্ট পেইন অনুভূত হতে পারে, যেমন- বিছানা বা চেয়ার থেকে ওঠার সময়। কাশি দেয়ার সময় বা বিছানায় নড়াচড়া করার সময়ও এ ব্যাথা হতে পারে। রাউন্ড লিগামেন্ট পেইনের কারণে শারীরিক ধকল গেলেও চাপা ব্যাথা অনুভূত হতে পারে।
রাউন্ড লিগামেন্ট পেইন এক ধরনের তীব্র ব্যাথা যা সাধারনত অল্প সময়ের জন্য হয় এবং অনেকটা মাংশপেশীর খিঁচুনির মত মনে হতে পারে। এ ব্যাথা দুপাশেই হতে পারে তবে ডান পাশে বেশী হয় যা কুঁচকি (gorin) পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন
ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশনের সময় জরায়ু, তলপেট বা কুঁচকির অংশে সংকোচন অনুভূত হয়। অর্থাৎ এসব অংশ একবার শক্ত হয়ে যায় আবার ছেঁড়ে দেয়। প্রসবের সময়ও এ ধরনের অনুভূতিই হয়। তবে ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন এবং আসল প্রসব যন্ত্রণার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন সাধারণত অনিয়মিত এবং ব্যাথাহীন হয়। তবে তা মাঝে মাঝে তীব্র, ব্যাথাযুক্ত এবং অস্বস্তিকর হতে পারে। প্রসব শুরুর লক্ষন বা আসল প্রসব বেদনা সম্পর্কে আমাদের লেখা আর্টিকেল থেকে জেনে নিন।
প্রসবের কাছাকাছি সময়ে ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন নিয়মিত, ঘন ঘন এবং ব্যাথাযুক্ত হয়ে উঠতে পারে যার কারণে আপনার মনে হতে পারে যে আপনার প্রসব শুর হচ্ছে। তবে আসল প্রসব বেদনার সাথে এর কিছু পার্থক্য আছে, যেমন- প্রসব বেদনার মত এ ধরনের কন্ট্রাকশন আস্তে আস্তে বাড়তে থাকেনা বা তীব্রতর হয়না এবং কন্ত্রাকশনের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যাবধান কমতে থাকেনা। ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন সাধারণত ৩০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট ধরে হতে পারে তবে ঘণ্টায় একবার বা দুবারের বেশী হয়না। বেশীরভাগ সময়ই শরীরের অবস্থান পরিবর্তন করলে বা বিশ্রাম নিলে এটি চলে যায়।
যদি গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের আগে নিয়মিত, ব্যাথাযুক্ত, ঘন ঘন কন্ট্রাকশন হয় বা এর সাথে প্রি-টার্ম লেবারের লক্ষন দেখা যায় তবে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে। প্রি-টার্ম লেবারের লক্ষন যেমন- পেটে ব্যাথা বা পিরিয়ডের মত পেটে খিল ধরা ভাব, নিয়মিত কন্ট্রাকশন ( ঘণ্টায় অন্তত ৪ বার বা তার বেশী বা ১০ মিনিট অন্তর, যদি তাতে ব্যাথা নাও থাকে), যোনী পথে রক্তপাত বা স্পটিং, যোনিপথে নির্গত তরলে পরিমান বেড়ে যাওয়া বা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া, পেলভিসে বা তলপেটে চাপ অনুভব করা এবং পিঠের নিচের দিকে ব্যাথা ইত্যাদি দেখা গেলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
যদি গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ অতিক্রম করে যায় এবং কিছু লক্ষন দেখা যায়, যেমন- পানি ভেঙ্গে যাওয়া (কন্ট্রাকশন না হলেও), যোনী পথে রক্তপাত, অল্প সময়ের ব্যাবধানে কন্ট্রাকশন, তীব্র ব্যাথা ইত্যাদি দেখা যায় তবে তা প্রসব শুরু লক্ষন হিসেবে ধরে নিতে পারেন এবং অতিসত্বর ডাক্তারকে জানাতে হবে।
যে সব কারণে গর্ভাবস্থায় পেট ব্যাথা হওয়া ভয়ের কারণ
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি
গর্ভধারণের সঠিক স্থান হচ্ছে জরায়ু। স্বাভাবিক গর্ভধারণে নিষিক্ত ডিম্বকোষ গর্ভ বা জরায়ুতে স্থান নেয়। সেখানে ডিম্বকোষ বিভক্ত হওয়ার, শিশুতে পরিণত হওয়ার, শিশু বেড়ে ওঠার মতো পর্যাপ্ত জায়গা আছে।এর বাইরে যে কোন স্থানে গর্ভধারণ হলে তাকে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলা হয়।ভ্রুণের তৈরি হয় ফেলোপিয়ান টিউবেই৷ তবে টিউবের সঙ্গে জরায়ুর যে সংযোগ রয়েছে সেই পথে কোনও কারণে সুগম না হলে ভ্রুণ জরায়ুতে যেতে পারে না৷ ফলে সেটি ফেলোপিয়ান টিউবের মধ্যেই বাড়তে থাকে৷ একেই মূলত এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ বলা হয়৷
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণ নরমাল প্রেগনেন্সির থেকে খুব আলাদা কিছু হয় না প্রথম দিকে। ডিম্বনালী রাপচার বা ফেটে যাবার আগ পর্যন্ত এই রোগের কোন লক্ষণথাকে না। টিউব ফেটে যাবার সময় কিছু লক্ষণপ্রকাশ পায়। লক্ষনগুলো নিম্নরূপঃ
- তলপেটের এক পার্শ্বে প্রচন্ড ব্যথা।
- মাসিক বন্ধ।
- হালকা রক্তস্রাব।
- বমি বমি ভাব।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (Syncopal Attack)।
- ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।
- পেট শক্ত হয়ে যাওয়া।
- ঘাড়ে ব্যাথা হওয়া
- শারীরিক পরিশ্রমের সময় ব্যাথা বেড়ে যাওয়া
এসব লক্ষন দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে। রোগটির বিভিন্ন ধরণ ও মাত্রা রয়েছে, সে অনুযায়ী যে কোনো মুহুর্তেই মারাত্মক বিপত্তি ঘটে যেতে পারে।
গর্ভপাত
গর্ভধারণ করার পর প্রসবকাল পর্যন্ত চল্লিশ সপ্তাহের পরিক্রমায় জমাট পানি থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশুর অবয়ব পর্যন্ত বিভিন্ন আকার-প্রকার ধারণ করে। এর প্রথম চতুর্থ সপ্তাহ থেকে আটাশ সপ্তাহের মধ্যে যদি কোন কারণে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয় তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত।
গর্ভস্থ শিশু, মা, বাবার বা দুইজনের শারীরিক ত্রুটির কারণে গর্ভপাত হয়। মায়ের যদি হাইপ্রেসার, ডায়াবেটিস, হঠাৎ কোন কারণে জ্বর হয়। এছাড়া রক্ত ও জরায়ুর সংক্রমণ, রক্তে টোপস্নাজমার সংক্রমণ হলে ও জরায়ুতে টিউমার বা ফাইব্রয়েড থাকলে গর্ভপাত হতে পারে। অনেক সময় বাচ্চা ধরে রাখার ক্ষমতা জরায়ুর থাকে না। ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে বলে সারভাইবাল ইনকমপিটেন্স। জরায়ুর পানি কম থাকলেও গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু হতে পারে।
মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের আরো অনেক কারণ আছে। যেমন, জেনেটিক ডিফেক্ট, ক্রোমজমের অ্যাবনরমালিটি, হরমোনাল ডিফেক্ট ইত্যাদি। হরমোন প্রজেস্টোরন ও এইচসিজি মায়ের জরায়ুকে ইরিটেট করা থেকে শান্ত রাখে। অর্থাৎ ক্রমাগত ধাক্কা থেকে মুক্ত রাখে। ফলে বাচ্চা মাতৃগর্ভে অক্ষত থাকে। কিন্তু এই দুই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে গেলে বা কমে গেলে, অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে, বাচ্চা বেরিয়ে যেতে পারে।
গর্ভপাতের ক্ষেত্রে রক্তপাত বা স্পটিং দেখা দিতে পারে। এর কিছুক্ষন বা কয়েকদিন পর পেটে ব্যাথা হতে পারে। রক্তপাত হালকা বা বেশী হতে পারে। এ সময় ব্যাথা লোয়ার ব্যাক পেইন বা পেলভিসে চাপ দেয়ার মত হতে পারে। এ ধরনের লক্ষন দেখা গেলে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে।
প্রি-টার্ম লেবার
স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা সাধারণত ৪০ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। এর সময় শুরু হয় শেষ মাসিকের প্রথম দিন হতে। লেবার বা প্রসব যন্ত্রণা গর্ভাবস্থার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যাতে জরায়ুর সঙ্কোচনের ফলে Cervix বা জারায়ু মুখ পাতলা হয়ে যায় এবং খুলে যায় যার ফলে বাচ্চা বেড়িয়ে আসতে পারে। এ প্রক্রিয়া টি স্বাভাবিক অবস্থায় গর্ভাবস্থার ৩৭-৪২ সপ্তাহের মধ্যে হয়।যদি কোন কারণে ৩৭ সপ্তাহের আগেই গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত জরায়ু সংকোচন হতে থাকে এবং তার ফলে জরায়ু মুখ খুলে যায় তবে তাকে প্রি-টার্ম লেবার বলে। এটি প্রি-ম্যাচিউর লেবার নামেও পরিচিত।
নিচের লক্ষন গুলো দেখা দিলে দেরী না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে-
- যোনিপথে নির্গত স্রাবের পরিমান বেড়ে গেলে বা স্রাব পানির মত, শ্লেষ্মা জাতীয় বা রক্ত মিশ্রিত থাকলে।
- যোনিপথে রক্ত বা স্পটিং দেখা গেলে।
- প্রতি ১০ মিনিট অন্তর বা প্রতি ঘণ্টায় চারবার বা তার বেশি জরায়ুর সঙ্কোচনের ফলে তলপেটে ব্যথা অনুভূত হলে, পাশাপাশি কোমরে ব্যথা বা খিল ধরা অনুভুতি হলে। জরায়ু সঙ্কোচনের ফলে ব্যাথা অনুভব না হলেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
- পেলভিক এরিয়াতে বেশী চাপ অনুভব করলে। (যদি মনে হয় বাচ্চা নিচের দিকে চাপ দিচ্ছে)
- অনবরত চাপা বা কিছুক্ষন পর পর পিঠে ব্যাথা করলে।
- যদি মনে হয় আপনার পানি ভেঙ্গে গেছে এবং যোনিপথে অতিরিক্ত তরল নির্গত হলে।
- ডায়রিয়ার কারণে বা ডায়রিয়া ছাড়াই পেটে খিলধরা অনুভুতি থাকলে।
এই লক্ষনগুলো অনেক সময় বিভ্রান্তিকর কারণ কিছু কিছু লক্ষন গর্ভাবস্থায় হওয়াটা স্বাভাবিক যেমন- পেলভিকে চাপ বা লো ব্যাক্ পেইন। এছাড়াও অনিয়মিত সংকোচন ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশনের কারনেও হতে পারে। তাই আপনার যদি মনে সামান্যতম সন্দেহ হয় যে সবকিছু ঠিক নেয় তাহলে দেরী না করে দ্রুত ডাক্তারের সাথে দেখা করুন। ফলস লেবার কিনা সেটা নিয়ে ভাববেন না। নিজের মনে অনেক কিছু ভাবার চাইতে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিশ্চিত হওয়াটা সবসময়ই উপকারী।
প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন
প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন একটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা যেটি সম্পর্কে গর্ভবতী মায়েদের জেনে রাখা ভালো। গর্ভকালীন বা সন্তান প্রসবের পূর্বে অনেক সময় প্লাসেন্টা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জরায়ুর দেয়াল থেকে আলাদা হয়ে যায় বা ছিঁড়ে যেতে পারে। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে শিশুর শরীরে অক্সিজেন ও পুষ্টির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। এর কারণে অতিরিক্ত রক্তপাত ঘটতে পারে যা মা ও শিশু দুজনের জন্যই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশনের কারণে বাচ্চার বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি এর মাত্রা বেশী হয় তবে প্রি-ম্যাচিউর (অপরিনত) সন্তান প্রসব এমনকি গর্ভে সন্তানের মৃত্যু ও ঘটতে পারে।
প্রতি ১০টি অ্যাবরাপশনের ৮ টির ক্ষেত্রেই যোনিপথে রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্তক্ষরণের পরিমাণ অল্পও হতে পারে বা প্রকট আকারেও দেখা দিতে পারে। রক্ত কখনো উজ্জ্বল লাল আবার কখনো গাঁড় বর্ণের হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যোনিপথে রক্তক্ষরণ নাও দেখা যেতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে রক্ত প্লাসেন্টার পেছনে জরায়ুতেই রয়ে যায়। এমনটা হলে আপনি কোমরের পেছনে এবং পেটে ব্যাথা অনুভব করবেন। ১০ টির মধ্যে ৭ টির ক্ষেত্রেই জরায়ু স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে এবং ব্যাথা অনুভূত হয় ।
যেহেতু প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন আপনার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় তাই নিম্নলিখিত কোন উপসর্গ দেখা দিলেই ভালভাবে চেক-আপের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন-
- যোনিপথে স্পটিং বা রক্তক্ষরণ দেখা দিলে।
- যদি আপনার পানি ভেঙ্গে যায় এবং তাতে রক্তের ছাপ থাকে।
- পেটে ব্যাথা হওয়া বা স্পর্শকাতর হয়ে ওঠা।
- ব্যাক পেইন।
- জরায়ুতে ঘন ঘন এবং একটানা সংকোচন অনুভব করা।
- বাচ্চার নড়াচড়া লক্ষনীয়ভাবে কমে গেলে।
প্রি-একলাম্পশিয়া
প্রি-একলাম্পশিয়া বা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গর্ভাবস্থায় উচ্চরক্ত চাপ থেকে পরবর্তীতে হার্ট ও কিডনি সমস্যার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে গর্ভাবস্থায় শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ মহিলা উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হন। এ সময় গর্ভবতী মহিলার রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিমি: অব মারকারির চেয়ে বেড়ে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয়প্রি-একলাম্পশিয়া। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রি-একলাম্পশিয়া ও একলাম্পশিয়া পৃথিবীতে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। প্রি-একলাম্পশিয়া লক্ষণ হচ্ছে
- শরীরে অতিরিক্ত পানি আসার কারণে ওজন বেড়ে যাওয়া (সপ্তাহে ১ কেজি)
- ইডিমা বা শরীরে পানি আসা : হঠাৎ মুখে পানি আসা একটি বিপজ্জনক চিহ্ন যার ফলে খিঁচুনি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে রেফার করা প্রয়োজন।
- প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া বা পরিমাণে অত্যন্ত কমে যাওয়া।
- মাথাব্যথা বা ক্রমশ প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হওয়া এবং মাথার পেছনে বা সামনে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা।
- উপরের পেটে প্রচণ্ড ব্যথা (ডান পাঁজরের নিচে)।
- বমি হওয়া।
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন
মূত্রতন্ত্রের যেকোনো অংশে জীবাণু সংক্রমণ হলে তাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মুত্রনালীর সংক্রমণ বলে। কিডনি, মূত্রনালি বা মূত্রথলি অথবা একাধিক অংশে একসঙ্গে ইনফেকশন হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যদি এ সংক্রমণ হয়, আর এর যদি চিকিৎসা না হয়, একদিকে মায়ের যেমন ক্ষতি হতে পারে, গর্ভজাত সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার মৃত্যু হতে পারে। কাজেই বারবার ইউটিআই হলে অনেক ক্ষতি হতে পারে। এটি বারবার হতে থাকলে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় এর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায় কারণ এ সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ব্যাকটেরিয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক্টে পৌঁছান সহজ হয়। এ ছাড়াও গর্ভাবস্থায় বর্ধিত জরায়ু ব্লাডারের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে যার ফলে প্রস্রাব করার সময় মায়েদের ব্লাডার পুরোপুরি খালি হয়না। ফলে ব্যাকটেরিয়া বংশবিস্তার করার অনেক সময় পায়।
ব্লাডার ইনফেকশনের লক্ষন একেকজনের একেকরকম হতে পারে। সাধারণ লক্ষন গুলো হোল-
- প্রশ্রাবের সময় বা শারীরিক মিলনের সময় ব্যাথা, অস্বস্তি বা জ্বালাপোড়া করা।
- পেলভিসে অস্বস্তিবোধ হওয়া বা তলপেটে ব্যাথা।
- ঘনঘন প্রস্রাব পাওয়া বা নিয়ন্ত্রন করতে না পারা। যদি প্রস্রাবের পরিমান অনেক কম থাকে।
- এছাড়াও প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হতে পারে এবং প্রস্রাব ঘোলা হতে পারে। প্রস্রাবে রক্ত থাকতে পারে এবং শরীরের তাপমাত্রা হালকা বৃদ্ধি পেটে পারে।
যেহেতু গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া স্বাভাবিক তাই ইনফেকশনে লক্ষন আপনি নাও বুঝতে পারেন যদি না আর কোন লক্ষন দেখা না যায়। তাই কোন কারণে যদি মনে হয় আপনার ইনফেকশন হয়েছে তাহলে দ্রুত ডাক্তারকে জানান।
এপেন্ডাইসিটিস
গর্ভাবস্থায় এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা নির্ণয় করা বেশ কঠিন। যেহেতু জরায়ু এসময় বড় হয়ে যায়, তাই এপেন্ডিক্স সরে গিয়ে নাভি বা লিভারের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। যেহেতু এটা নির্ণয় করা বেশ সমস্যাজনক, তাই সতর্ক থাকতে হবে। স্বাভাবিক লক্ষণ গুলো হচ্ছে খাবারে অরুচি, বমি।
পিত্তথলিতে পাথর
এই কারণেও গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হতে পারে। যাদের বয়স ৩৫ এর উপর এবং ওজন বেশি। এর ফলে সৃষ্ট ব্যথাকে মোটেই উপেক্ষা করা যাবে না এবং দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ব্যথা ছড়িয়ে পারতে পেটের সামনে থেকে পিঠের দিকেও। তাই সচেতন হওয়া জরুরি।
সবশেষে আবার মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনার যদি মনে সামান্যতম সন্দেহ হয় যে সবকিছু ঠিক নেয় তাহলে দেরী না করে দ্রুত ডাক্তারের সাথে দেখা করুন। নিজের মনে অনেক কিছু ভাবার চাইতে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিশ্চিত হওয়াটা সবসময়ই উপকারী।
সবার জন্য শুভকামনা।
Source: fairy land