শিশুর বেড়ে ওঠা । ষষ্ট মাস
৬ মাস বয়সে শিশুর খাবার
শিশুর জীবনে ষষ্ট মাস সময়টি যে কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা হোলো, এ সময় শিশুকে তার জীবনের প্রথম সলিড খাবার শুরু করার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। একেবারে প্রারম্ভে অর্ধ তরল (Semi Solid) সহজ পাচ্য খাদ্যপোকরণ দিয়ে তৈরি খাবার খাওয়ানো নিরাপদ।
এ সময় বাচ্চা ঠিক যতটুকু খেতে চায় ততটুকুই দিতে হবে। শারীরিক প্রয়োজন, পাকস্থলীর কার্যকারিতা এবং বাচ্চার নিজস্ব রুচির কারণে একেকটি বাচ্চার খাদ্য গ্রহনের পরিমাণ ও আগ্রহ ভিন্ন হতে পারে। সুতরাং যথেষ্ট পরিমাণ বুকের দুধ পেলে সলিড খাবারের পরিমাণ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছুই নেই। যথেষ্ট পরিমানে মায়ের বুকের দুধ না পেলে ফর্মুলা দুধ এবং অন্যান্য তরল পুষ্টিকর খাবার দিতে কার্পণ্য না করায় বাঞ্ছনীয় ।
বিশেষ কোন প্রয়োজন ছাড়া (যেমন ভ্রমন ইত্যাদি) প্যাকেটজাত সিরিয়াল, জুস, প্রক্রিয়াজাত খাবার ( processed meat, processed cheese) বাচ্চার জন্য কোনভাবেই উপযোগী নয়। এ সময় আপনার বাচ্চার মলের প্রকৃতি এবং রং পরিবর্তিত হতে পারে, কিংবা দুর্গন্ধযুক্ত মলত্যাগ করতে পারে। এতে চিন্তার কিছু নেই। দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার শুরু করার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। তবে যে কোন নতুন খাবার শুরু করার পর সেটি বাচ্চার ঠিক ভাবে হজম হচ্ছে কিনা সেটিও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। মায়ের দুধ অন্য যেকোনো খাবার খাওয়ানোর জন্য যেহেতু তৈজসপত্র প্রয়োজন হয় ( বাটি, চামচ, বোতল) তাই অবশ্যই এ সব সামগ্রী প্রতিবার খাওয়ানোর আগে জীবাণুমুক্ত করে নেয়া প্রয়োজন।
বাচ্চার কি কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে?
আপনার শিশুর প্রথম কয়েক সপ্তাহে, মলত্যাগের রুটিন তৈরী হতে কিছুটা সময় লাগবে৷ একদিন হয়ত পায়খানা পাতলা হবে, আবার পরের দিন শক্ত হবে৷ কোনটা স্বাভাবিক আপনি শীঘ্রই বুঝতে পারবেন৷
যতদিন আপনার শিশু শুধুই বুকের দুধ খাবে, তার মল নরম থাকবে ও মলত্যাগ সহজ হবে৷ যখন ও শক্ত খাবার খেতে শুরু করে, তখন কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, হয়ত তার পায়খানা শক্ত হয়ে উঠবে, মলত্যাগ করতে কষ্ট হবে ও সাধারণত যতবার পায়খানা হত ততবার হবে না৷
কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণগুলি সহজেই বোঝা যায়৷
যদি পায়খানা করতে গিয়ে আপনার শিশু কান্নাকাটি করে, সেটা একটা লক্ষণ হতে পারে৷ আপনি এটাও লক্ষ্য করতে পারেন যে তার মল শুকনো ও শক্ত৷ সে স্বাভাবিকের তুলনায় কম পায়খানা করতে পারে, কখনো কখনো সারা সপ্তাহে মাত্র ৩ বার পায়খানা করতে পারে৷মল ও গ্যাসে দুর্গন্ধ হলে সেগুলিও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ৷ আরেকটা লক্ষণ হল পেট শক্ত হয়ে, ফুলে যাওয়া৷
আপনি কী করতে পারেন?
যদি আপনার শিশুর বয়স ৬ মাসের কম হয় এবং যদি আপনার মনে হয় যে তার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে তাহলে তাকে প্রচুর বুকের দুধ খাওয়ান৷ বুকের দুধই হল আদর্শ। পানি বা অন্য কোনো পানীয় দেবেন না, শুধু বুকের দুধ দিন৷
যদি আপনার শিশু শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে থাকে, তাহলে ওকে বুকের দুধ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ফল ও সব্জি খেতে দিন, আর পরিষ্কার, বিশুদ্ধ পানি খাওয়ান৷ এটা এটা মল নরম করতে সাহায্য করবে৷
কখনো কখনো খুব তরল পায়খানাও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ হয়৷ যে শক্ত মল পাচন তন্ত্রে বাধা সৃষ্টি করে তার চারপাশ দিয়ে তরল পায়খানা বেড়িয়ে আসতে পারে৷ যদি আপনার মনে হয় আপনার শিশুর এইরকম কিছু হয়েছে, তাহলে ডাক্তার দেখান৷
শিশুর দাঁত ওঠা
অনেক বাচ্চার এসময় থেকে দাঁত ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এ কারণে বাচ্চারা তাদের মাড়িতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে পারে ও তার চারপাশের যে কোন কিছু মুখে দেবার কিংবা মাড়ি দিয়ে চেপে ধরার প্রবনতা দেখা দেয়। এ সময় তার আসে পাশে নিরাপদ, জীবাণুমুক্ত ও নরম খেলনা (Teether) রাখতে পারেন।তবে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে কোন ছোট জিনিস অথবা পার্টস , কাগজ, টিস্যু পেপার ইত্যাদি যেন শিশুর নাগালের মধ্যে না থাকে (যেসব জিনিশে Choaking hazard হতে পারে)।
শিশু কখন হামাগুড়ি দেবে?
বসতে শেখার পরে শিশুর বড় সাফল্য হল হামাগুড়ি দিতে শেখা৷ ৬ থেকে ৯ মাস বয়সে পৌঁছে হয়ত আপনার শিশু হামাগুড়ি দিতে শিখে যায়৷ তার মানে, ১ বছর বয়সে সে ভালোভাবে হামাগুড়ি দিতে পারবে৷ তবে সব শিশু কিন্ত হামাগুড়ি দেয় না৷ হয়ত দেখবেন আপনার শিশু হামাগুড়ি না দিয়ে পিছন ঘষে চলে বেড়াচ্ছে৷ বা হয়ত সে পেট ঘষে ঘষে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷
কিছু শিশু একেবারেই হামাগুড়ি দেয় না৷ বরং তারা সরাসরি সোজা হয়ে দাঁড়াতে ও তারপরে হাঁটতে শিখে যায়৷ আপনার শিশু কীভাবে শিখছে তা জরুরি নয়, যা জরুরি তা হল আপনার শিশু যথেষ্ট ছটফটে কিনা৷বিভিন্ন গতিতে শিশুদের বিকাশ হয়৷ যদি আপনার চিন্তা হয় যে আপনার শিশুর হামাগুড়ি দিতে বা চলাফেরা করতে দেরী করছে তাহলে স্বাস্থ্য কর্মীর সঙ্গে কথা বলুন৷
অন্যান্য
এসময় বাচ্চার মানসিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। শ্রবণ ক্ষমতা ও দৃষ্টি শক্তি পরিপক্কতা লাভ করে। বাচ্চা শক্ত ভাবে কিছু ধরতে, মুঠো ছেড়ে দিতে শেখে। রঙিন ও শব্দ যুক্ত খেলনার প্রতি অনেক বেশী আকৃষ্ট হয়। পরিবারের সদস্যদের আলাদাভাবে চিনতে শেখে এবং বিশেষ প্রিয় ব্যাক্তিটির প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে। এ সময় থেকেই বাচ্চার মধ্যে Separation Anxiety পরিলক্ষিত হয়। বিশেস করে কর্মজীবী বাবা মায়েরা কাজে থাকাকালীন সময়ে বাচ্চা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে।
এ বয়সে বাচ্চা হয়তো একটা হাত অন্য হাতের তুলনায় বেশি ব্যবহার করতে শুরু করবে। কিন্তু তার দু তিন বছর বয়েসের আগে সঠিকভাবে বোঝা যাবেনা যে সে ডান-হাতি না বাঁ-হাতি। ওকে ছোট একটা জিনিস ধরে এ-হাত ও-হাত করতে দিন। এতে ওর দক্ষতা গড়ে উঠতে সাহায্য হবে। বাচ্চাকে কোন একটি হাত ব্যাবহার করতে জোর করা উচিত নয়। কারন বাচ্চা ডান হাতি না বা-হাতি হবে তা জন্মের আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়। আপনার বাচ্চা যদি বা-হাতি হয় কিন্তু তাকে যদি ডান হাত ব্যাবহার করতে জোর করা হয় তবে পরবর্তীতে তার হ্যান্ড-আই কোরডিনেশনে সমস্যা হতে পারে।
শিশু এ সময় মাটিতে বিছানায় কিংবা আপনার কোলে পায়ে ভড় দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে শুরু করবে, তার অনুভূতি গুলো পেছনের সময়গুলোর চাইতে আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে শিখবে যেমন- কাউকে দেখে খুশী হওয়া, অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করা, বিরক্ত প্রদর্শন করা, মন মতো কিছু না হলে ক্ষোভ প্রকাশ করা ইত্যাদি।
শিশুর মাইলস্টোনঃ ৬ মাস
- শিশুহাসবে, কিছু বলার চেস্টা করবে।
- গড়াগড়িকরবে।
- কোনকিছুতে বাধা দিলে বা ‘না’ বললে বুঝতে পারবে।
- চারপাশেরজিনিস চিনতে শিখবে।
- এই বয়সে শিশুরা উবু হয়ে শুয়ে থাকলেমাথা ও বুক উপরে তুলতে পারা উচিৎ।
- শিশুরা এই বয়সে বিভিন্ন জিনিস ধরার চেষ্টা করে এবং ধরে ঝাঁকাতে চেষ্টা করে।
- এই বয়সে শিশুরা দুদিকে ঘাড় ঘোরাতে পারে।
- অন্যের সাহায্য নিয়ে বসতে পারে।
- শিশুদের এক ধরণের প্রবণতা তৈরি হয় সেটি হল হাত ও মুখ দিয়ে সব জিনিস যাচাই করার চেষ্টা।
- এমনকি শিশুরা ধীরে ধীরে শব্দ ও মুখের ভাব অনুকরণ করা শুরু করে।
- শিশুরা নিজের নাম শুনলে বা পরিচিত মুখ দেখলে এক ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখায়।
- দাঁর করালে পায়ের উপর ভর দিতে পারে
- অন্যদের মুখভঙ্গী দেখে অনুভুতি পড়ার চেষ্টা করা শুরু করে।
- মা অথবা যিনি সর্বাধিক যত্ন নেন (খাবার খেতে দেন) তার সাথে অন্যদের পার্থক্য করতে শেখে।
- উজ্জ্বল রঙের বস্ত ও এর নড়াচড়ার দিকে খেয়াল করে এবং সাড়া দেয়।
- শব্দের দিকে ঘুরে তাকায়।
- অন্যের চেহারার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়।
- আপনি তার দিকে তাকিয়ে হাসলে সেও ফিরতি হাসি দেয়।
বাবা-মা এর করণীয়:
- শিশুরসাথে খেলা করুন, গোসলের সময় হাসানোর চেষ্টা করুন।
- শিশুরকথার বিপরীতে কথা বলুন।
- রঙিনবই নিয়ে পড়ুন।
- বিভিন্নজিনিসের নাম শিখান।
- শিশুকেখেলার সুযোগ দিন ও ঘর শিশুর জন্য নিরাপদ রাখুন। শিশুর খাওয়া, ঘুম ও খেলা রুটিন মত করানোর চেষ্টা করুন।
বিপদ চিহ্ন:
- জড়সড় বা নিস্তেজ থাকা।
- চলন্ত কিছুর দিকে দৃস্টি না দেয়া।
- মাথার ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারা
- কারও দিকে তাকিয়ে না হাঁসা।
- আকর্ষনীয়কিছু দেখলে আগ্রহী না হওয়া
- কোন ধরনের শব্দ না করা
- দাঁর করিয়ে দিলে পায়ে ভর দিতে না পারা।
- কোন কিছু হাত দিয়ে মুখের কাছে না আনা
এ সময় কি কি মাইলস্টোন আপনার শিশু অর্জন করতে যাচ্ছে তা জানার সাথে সাথে ভুলে যাবেন না যে এট শুধু মাত্র একটা গাইডলাইন। প্রতিটি শিশুই ইউনিক ( স্বকীয় ) এবং তার বেড়ে ওঠার গতিও ভিন্ন।যে শিশুটি অন্যদের থেকে প্রথমে বসতে শিখেছে সে হয়ত সবার শেষে হামাগুড়ি দিতে শিখবে। অথবা ১৮ মাস বয়সী যে শিশুটি শব্দ ও অঙ্গাভঙ্গির মাধ্যমে এখনো ভাবের আদান প্রদান করছে সে হটাৎ করেই দুই বছর বয়সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্য বলা শুরু করতে পারে।এই টাইমলাইন সিরিজ যেন আপনার কোন রকম দুঃশ্চিন্তার কারন না হয় খেয়াল রাখবেন। প্রতিটি টাইমলাইনকে একটি গাইড হিসেবে ধরে নিতে হবে ।নবজাতক এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
Source: fairy land