শিশুর বেড়ে ওঠা। প্রথম মাস

জন্মের প্রথম মাস থেকেই আপনার শিশুর চেহারা ও শারীরিক বৃদ্ধি ছাড়াও তার ইন্দ্রিয় ও মোটর স্কিল এর উন্নতি হতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে একটি চার সপ্তাহ বয়সের শিশু ও “মা” এবং “না” শব্দের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। এখনই তারা বিভিন্ন ধরণের শব্দের মাধ্যমে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে।

অনেক মা এটা ভেবে চিন্তিত থাকেন যে বাচ্চা পরিমান মত দুধ পাচ্ছে কিনা, কারণ বাচ্চা হয়ত কিছুক্ষন পরপরই কাঁদছে। এটা খুবই স্বাভাবিক কারণ খাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক এর মধ্যেই বাচ্চার খাবার হজম হয়ে যায়।

কিছু কিছু জিনিষ খেয়াল করলেই আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে আপনার বাচ্চা পরিমান মত দুধ পাচ্ছে। বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের বুক নরম ও খালি বোধ হওয়া, বাচ্চার গায়ের রঙ পরিষ্কার থাকা, বাচ্চার শরীরের কোন অংশে চাপ দিলে টা দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসা, বাচ্চার ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধি, দিনে ৬ থেকে ৮ বার পস্রাব পায়খানা হওয়া ইত্যাদি।

জন্মের প্রথম দিকে meconium (গর্ভে থাকাকালীন অন্ত্রে উৎপন্ন হওয়া একধরনের পদার্থ) এর কারনে বাচ্চার পায়খানা ঘন ও গাড় সবুজ বর্ণের হয়। বাচ্চা খাওয়া শুরু করার পর meconium আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকে এবং পায়খানার রঙ হলুদ এর দিকে যেতে থাকে। তবে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের ডায়েট বা ফর্মুলা খাওয়ানো বাচ্চাদের ফর্মুলার ধরন ও পরিমান এর উপর নির্ভর করে রঙ পরিবর্তিত হতে পারে। একটি নবজাতক দৈনিক ৮ থেকে ১২ বার পর্যন্ত মল মুত্র ত্যাগ করতে পারে। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের মল সাধারণত নরম অনেকটা ডায়রিয়ার মত দেখতে হয়।

প্রথম মাসে বাচ্চার ঘুম

এই সময়টাতে বাচ্চা বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। বাচ্চাকে চিত করে শোওয়ানো সবচাইতে নিরাপদ কারণ এতে SIDS এর রিস্ক কমে যায়। কিন্তু বাচ্চা যখন জেগে থাকে, তাকে উপুড় হয়ে থাকতে দিন। এতে ঘাড়ের মাংশপেশী শক্ত হয়।

বাচ্চা যখনি ঘুমায় তখন নিজেও কিছুটা ঘুম বা বিশ্রাম এর চেষ্টা করুন। কারণ আগামী বেশ কিছু মাস আপনার নির্ঘুম রাত কাটানোর সম্ভাবনাই বেশী।

প্রথম মাসে বাচ্চার কান্না

বাচ্চা যদি অনেক বেশী কান্না করে, সাধারানত তিন ঘণ্টা বা তার বেশী, সপ্তাহে তিন বা চার দিনের বেশী এবং তার যদি কোন ব্যাখ্যা না থাকে, ধরে নিতে পারেন বাচ্চা হয়ত colicky.  কোন কারন ছাড়া সুস্থ বাচ্চার অতিরিক্ত কান্নাকাটিকে সাধারণত colic বলে।  ১৫ থেকে ২০ ভাগ নবজাতক এর ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়। colic কি কারনে হয় টা এখন জানা যায়নি। তবে হজমের সমস্যা, reflux, বা পরিবেশগত কারনে colic হতে পারে মনে করা হয়।

Colic এর কারনে বাচ্চা যে কোন সময় কান্না করতে পারে। তবে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কান্না বেশী থাকে। এতে ভয় এর কোন কারণ নেই কারণ ৬০ ভাগ বাচ্চার ক্ষেত্রে তা ৩ মাসের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। ৯০ ভাগ বাচ্চা ৪ মাস এর মদ্ধে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠে।

এ সময় গুলোতে আপনার আদর এবং ভালবাসা বাচ্চাকে আরাম দিতে পারে।

সন্তান জন্মদানের পর বেশীরভাগ মা ই (৬০-৮০ ভাগ) অবসাদ এ আক্রান্ত হতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তবে তা যদি ২ থেকে ৩ সপ্তাহের বেশী স্থায়ী হয় এবং আপনি সারাদিন ই অবসাদগ্রস্থ থাকেন, কোন কাজেই আপনার উৎসাহ না থাকে, খাবারে অরুচি, আতঙ্কিত, অপরাধ বোধ, ঘুমের সমস্যা এমনকি আত্মহত্যার চিন্তার মত উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে Postpartum Depression  এর আশঙ্কায় বেশী। এক্ষেত্রে অতিসত্বর চিকিৎসক  এর পরামর্শ নিন। এতে আপনার সাথে সাথে আপনার বাচ্চা এবং পুরো পরিবার ই উপকৃত হবে।

 

১ মাস বয়সে শিশুর ইন্দ্রিয়

  • শ্রবণশক্তি

শিশুর শ্রবণশক্তি এখন অনেকটাই সংবেদনশীল এবং সম্পূর্ণরূপে বিকশিত। তারা এখন শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘোরাতে চেষ্টা করবে। ঘরের একপ্রান্ত থেকে তালি দিয়ে বা ঝুনঝুনি বাজিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করুন। দেখবেন তারা হয়তো কিছুটা ঝাঁকুনি দিয়ে উথবে।

আপনি আপনার বাচ্ছাকে নার্সারি রাইম বা কিছু মৃদু গান বাজিয়ে শোনাতে পারেন। দেখবেন তারা ভিন্ন ভিন্ন গানে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।

  • দৃষ্টি শক্তি

এই সময় শিশুর দৃষ্টি ঝাপসা থাকে। শিশুরা সাধারণত ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি দুরত্তের জিনিস দেখতে পায়। তাই বাচ্চার মুখের কাছে মুখ আনলেই সে আপনাকে দেখতে পাবে। বাচ্চা যদি চোখে চোখ না রাখে ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। কারণ এ বয়সী বাচ্চার সাধারণত ভ্রু, চুল বা আপনার মুখের নড়াচড়াই ভালভাবে খেয়াল করে। গবেষণায় দেখা গেছে মানুষের মুখ অন্য যে কোন কিছুর চাইতে নবজাতক কে বেশী আকর্ষণ করে।

মাথা ঘুড়িয়ে বা চোখের সাহায্যে তারা চলমান বস্তুকে অনুসরণ করে। কিন্তু যখনই তা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায় সেটার অস্তিত্ত তারা ভুলে যায়। যদি কখনো শিশুর ট্যারা চোখ দেখেন তাহলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ফোকাস করার জন্য তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। এ বয়সের শিশুর বেশীরভাগ খেলনাই সাদা কালো হয় কারণ হাই কন্ট্রাস্ট রং তারা সহজে খুঁজে পায়।

১ মাস বয়সে শিশুর মোটর স্কিল

  • শিশুর নড়াচড়া ও সচেতনতা

এ বয়সে শিশু তার হাত ও পায়ের অস্তিত্ব বুঝতে পারলেও তা নাড়ানো সমন্বয় করতে আরও মাস খানেক বা মাস দুয়েক সময় লাগবে।

  • মাথা নাড়ানো

শিশুর ঘাড়ের পেশী এখনও অনেক দুর্বল। তারপর ও খেয়াল করবেন যখন সে তার পেটের উপর শুয়ে থাকে বা আপনার কোলে থাকে তখন সে তার মাথা হয়তবা সামান্য তুলে ধরতে পারে। এ ছাড়াও এসময় শিশু মাথা এদিক ওদিক সামান্য নাড়াতে পারে।

 

কিভাবে প্রথম মাসে আপনার শিশুর বিকাশে সাহায্য করবেন

শিশুর সাথে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলুন এবং অনেক আই কন্টাক্ট করুন। যদিও সে আপনার কথা কিছুই বুঝবেনা কিন্তু আপনার গলার স্বর তাকে শান্ত রাখবে এবং এখন থেকেই তার ভাষার বিকাশে সাহায্য করবে। উজ্জ্বল রং এর ঝুনঝুনি তার দৃষ্টি সীমার মধ্যে নাড়াতে থাকুন যাতে সে তার দৃষ্টি দিয়ে তা অনুসরণ করতে পারে। শিশুর বিছানার উপর উজ্জ্বল রং এর কিছু ঝুলিয়ে রাখুন। এতে তার ফোকাস এর উন্নতি হবে।

বাচ্চারা চুষতে পছন্দ করে। তাই এটা থামানোর চেষ্টা করবেন না। অনেক সময় যখন কোন কিছুই কাজ করেনা একমাত্র চুসনি বাচ্চা কে শান্ত করতে পারে।  American Academy of Pediatrics এর গবেষণায় দেখা গেছে ঘুমানোর সময় চুষনির ব্যাবহার SIDS এর আশঙ্কা কম করে।

মনে রাখা উচিত প্রত্যেকটি বাচ্চাই এক জন ভিন্ন মানুষ। তাই সব বাচ্চাই একই ভাবে বাড়বে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। নবজাতক এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

 

শিশুর বেড়ে ওঠার মাইলস্টোনঃ ১ মাস

  • এক সপ্তাহের মধ্যে মায়ের আওয়াজ, চেহারা ও স্পর্শ চিনতে শিখবে।
  • চলন্ত কিছুর দিকে তাকানো শিখবে।
  • মাথা ঘুরিয়ে শব্দের উৎসের দিকে তাকানো চেস্টা করবে।
  • ইন্দ্রিয় সচেতনতা যেমনঃ সাদা-কালো বা এজাতীয় রঙ এর চরম বৈপরীত্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, তাপমাত্রায় তারতম্য এবং শারিরীক ব্যাথা অনুভুতি জাগ্রত হওয়া শুরু করে।
  • ক্ষুধা এবং শারিরীক ব্যাথা জানান দেবার মাধ্যম হিসেবে কান্নাকে বেছে নেয়।

বাবা-মা এর করণীয়:

  • শিশুর সাথে কথা বলুন, কোলে নিন।শিশুর ঘুমানোর ও ক্ষুধার লক্ষনগুলো চিনতে শিখুন।
  • বারবার খাবার খাওয়ান।
  • খেলনা দিয়ে দৃস্টি আকর্ষন করুন।

বিপদ চিহ্ন:

প্রত্যেকটি বাচ্চাই তার নিজস্ব গতিতে বেড়ে ওঠে। তারপরও যদি প্রথম মাসে নিম্নলিখিত লক্ষন গুলো দেখেন তবে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন-

  • যদি খুবই আস্তে আস্তে খায় এবং ভালভাবে চুষতে না পারে।
  • যদি দৃষ্টি ফোকাস করতে না পারে এবং আশপাশের নড়াচড়া দিকে মনোযোগ না দেয়।
  • উজ্জ্বল আলোতে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখায়।
  • বাচ্চা যদি নেতিয়ে থাকে।
  • উচ্চ শব্দে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখায়।

 

এ সময় কি কি  মাইলস্টোন আপনার শিশু অর্জন করতে যাচ্ছে তা জানার সাথে সাথে ভুলে যাবেন না যে এট শুধু মাত্র একটা গাইডলাইন। প্রতিটি শিশুই ইউনিক ( স্বকীয় ) এবং তার বেড়ে ওঠার গতিও ভিন্ন।যে শিশুটি অন্যদের থেকে প্রথমে বসতে শিখেছে সে হয়ত সবার শেষে হামাগুড়ি দিতে শিখবে। অথবা ১৮ মাস বয়সী যে শিশুটি শব্দ ও অঙ্গাভঙ্গির মাধ্যমে এখনো ভাবের আদান প্রদান করছে সে হটাৎ করেই দুই বছর বয়সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্য বলা শুরু করতে পারে।এই টাইমলাইন সিরিজ যেন আপনার কোন রকম দুঃশ্চিন্তার কারন না হয় খেয়াল রাখবেন। প্রতিটি টাইমলাইনকে একটি গাইড হিসেবে ধরে নিতে হবে ।নবজাতক এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

Source: fairy land

Sharing is caring!

Comments are closed.