শিশুর আঁকাবাঁকা দাঁতের চিকিৎসা। ডা. গাজী শামীম হাসান।
প্রশ্ন : আঁকাবাঁকা দাঁত অত্যন্ত জটিল একটি সমস্যা। যাঁরা এই সমস্যাটিতে আছেন, তাঁরা বোঝেন এর কষ্ট কতখানি। একটু জানতে চাইব, শিশুদের ক্ষেত্রে এই আঁকাবাঁকা দাঁত হওয়ার কারণ কী?
উত্তর : যখন দুধের দাঁত আসে, ওপরে ও নিচে, তখন অনেক বাচ্চাই জিহ্বা দিয়ে দাঁত ঠেলে। জিহ্বার এই ঠেলার কারণে ওপরের দাঁতটি বসতে পারে না। আস্তে আস্তে নিচের চোয়ালটা বড় হতে থাকে। সে ক্ষেত্রে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আবার পেছনের চোয়াল যদি পেছনের দিকে চলে যায়, জায়গাটা কম হওয়ার জন্য দাঁতগুলো উঠতে পারে না এবং আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। এ জন্য মায়ের একটা বড় ভূমিকা এই দুধের দাঁত ওঠার সময়, পড়ার সময় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে দেখবেন, যে সময় দাঁত পড়ার কথা, সে ফেলছে না। আবার অনেক সময় দেখা যায়, একটি দুধের দাঁতে ক্যারিজ হয়ে গেছে, তখন মা মনে করেন এই ক্ষয়টা ঠিক করার দরকার নেই, কয়দিন পর তো পড়েই যাবে। আপনি দেখবেন, বাচ্চাদের এই ক্যারিজটা দুই দাঁতের মাঝখানে হয়। দুই দাঁতের মাঝখানে যখন হয়, তখন পরবর্তীকালে নতুন দাঁত এলে সেটি তখন মাঝখানে কাত হয়ে যায়। তখন নিচে যে দাঁত থাকে, এটা উঠতে পারে না। তখনই আঁকাবাঁকা হওয়া শুরু হয়। এর মানে বাচ্চাদের দাঁতে যদি ক্যারিজ হয়, আমাদের উচিত হবে এটা ঠিক করা। আপনি দেখবেন, আমাদের দেশে না হলেও বাইরের দেশ থেকে যেসব বাচ্চা আসে, তাদের দাঁতে কালো কালো ক্রাউন বা মুকুটের মতো কিছু একটা পরিয়ে দেওয়া। কারণ, ফিলিং করার চেয়ে যদি আমরা মেটালিক ক্যাপ করে দিতে পারি, দাঁতের নিয়ন্ত্রণটা বেশি হয়। এটি চাপ নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীকালে দাঁত ভালোভাবে উঠতে পারে। কোনো অবস্থায় দুধের দাঁত পড়ে যাবে বা আবার দাঁত নতুন করে উঠবে মনে করে একে ফেলে দেওয়া যেমন ঠিক নয়, এর চিকিৎসা না করে রাখাটাও উচিত নয়। এই জিনিস আমাদের খেয়াল রাখা উচিত।
প্রশ্ন : আমাদের দেশের এখনকার পরিস্থিতিতে দাঁতের চিকিৎসার পেছনে শিশুদের মা-বাবার আগ্রহ কেমন দেখেন?
উত্তর : এখন আগ্রহ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে আমরা অনেক রোগীকে পাই, যাঁরা নিজেরাই সচেতন। আমরা যদি বলি চারটা দাঁত ফেলতে হবে। বললে হয়তো ভয়ে কেঁদে চলে যাবে। মা-বাবা হয়তো ভয় পাচ্ছে, তবে বাচ্চা বলছে, কোনো অসুবিধা নেই, আমি দাঁত ফেলব। এর মানে মানুষের মধ্যে সৌন্দর্যবোধ অনেক বেড়েছে। আর এ কারণে তারা চায়, এটা সুন্দর হওয়ার জন্য। আরেকটি বিষয় হলো, বাচ্চার এখন একে অনেকটা ফ্যাশন হিসেবে নেয়।
প্রশ্ন : শিশুদের এই আঁকাবাঁকা দাঁত ঠিক করার জন্য আসলে কখন থেকে শুরু করা উচিত?
উত্তর : শিশুদের মা-বাবাকে বলব, অবশ্যই আপনারা শিশুদের সাত থেকে আট বছর বয়সের মধ্যে একবার দেখাবেন। ৯ থেকে ১১ বছর বয়সের মধ্যে একবার দেখাবেন। চিকিৎসক যদি মনে করেন, এখন চিকিৎসা শুরু করার সময় হয়ে গেছে, তাহলে করতে হবে। তবে কোনো অবস্থায় ১৪ পার করার পরে না। সবচেয়ে ভালো সময় হলো ১১ থেকে ১৩। ১৪ বছরের ওপরে গেলে তখন আবার অন্যভাবে চিন্তা করতে হয়।
আরেকটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, কোনো অবস্থায় বাচ্চাদের যেন ক্যারিজ হতে না পারে। অনেক সময় ছোট বাচ্চারা ব্রাশ করতে চায় না। এ জন্য মায়েদের উচিত হবে বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে আঙুলের মধ্যে কাপড় দিয়ে সুন্দর করে বাচ্চার দাঁত পরিষ্কার করে দেওয়া। তাহলেও এই ক্ষয়গুলো হবে না। আর রাতের বেলা যেন বোতল মুখে দিয়ে ঘুম না পাড়ায়। এতেও ক্ষয় হয়।
প্রশ্ন : শিশুর ক্যারিজ যদি ঠিকমতো পরীক্ষা করা না হয়, তাহলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : একটা তো চিকিৎসা না করলে আঁকাবাঁকা দাঁত হতে পারে। আঁকাবাঁকা দাঁত হলে ক্ষয় হবে, জিনজিভাইটিস হবে, দাঁত থেকে রক্ত আসতে পারে, দুর্গন্ধ আসতে পারে। এর চেয়ে বড় কথা হলো, যদি চিকিৎসা না করা হয়, সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো চোয়াল লম্বা হয়ে যায়।
প্রশ্ন : এই চোয়ালকে কীভাবে ঠিক করতে হবে?
উত্তর : আমাদের আঁকাবাঁকা হওয়ার একটি বিষয় দাঁতকেন্দ্রিক। এখন ওপরের মাড়ি ও নিচের মাড়ি বৃদ্ধির কারণেও আঁকাবাঁকা হয়।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা কি একটু জটিল হয়ে যায়?
উত্তর : একটু জটিল হয়ে যায়। তবে নয় বছর বয়সে যদি দেখি শিশুটির চোয়ালটা লম্বা হচ্ছে, তখন চোয়াল যাতে লম্বা না হতে পারে একে বাঁধা দেব। তাহলে আর হবে না। সুতরাং নয় বছরে না এসে যদি ১৭/১৮ বছরে আসে, তখন তো আর ছোট করা যাবে না। ছোট যেহেতু করা যায় না, এই দাঁতটিকে সার্জিক্যাল অবস্থায় আনা লাগে।
বাংলাদেশে দন্ত চিকিৎসকের একটি হচ্ছে অর্থডোনটিস্ট। আমরা আঁকাবাঁকা দাঁতের চিকিৎসা করি। সবচেয়ে বড় একটি বিভাগ রয়েছে ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সোলো ফেসিয়াল সার্জন। এরা প্রধানত সার্জারি করে। আমি দাঁত তুলতে পারলেও বিশেষজ্ঞ নই। যখন দাঁত লম্বা থাকে, চোয়ালকে কেটে ছোট করতে হয়। এই কাজটি করে ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সোলো ফেসিয়াল সার্জন। এটাকে বলা হয় অর্থগ্রেটিক সার্জন। আমরা কিছু কাজ করব, তারা কিছু কাজ করবে। কখনো একার পক্ষে এটি সম্ভব নয়।
তাই এই সার্জারি যেন না লাগে, এর জন্য যদি সে আট-নয় বছর বয়স থেকে বাচ্চাটির চিকিৎসা করায়, তাহলে এই বড় ধরনের সমস্যা থেকে সে মুক্তি পাবে। এটা একটি বড় ব্যাপার। সুতরাং ওরাল সার্জন যেহেতু এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা বিষয়টিতে খেয়াল রাখবেন।
অনেক মেয়ে বলে, আমার দাঁত সব সুন্দর ছিল। তবে ১৭/১৮ বছর হওয়ার পর দাঁত উঁচু হয়ে গেছে। এটা একটা প্রচলিত অভিযোগ। এ বয়সে যখন আক্কেল দাঁত ওঠা শুরু করে, এর জন্য মুখের ভেতর জায়গা থাকে না। ওই চাপে চোয়াল সামনে চলে আসে। সে জন্য উচিত হবে ১৫ বছর বয়সে ওরাল সার্জনের কাছে গিয়ে রুটিন চেকআপ করানো। সমস্যা হলে তখন আক্কেল দাঁত ফেলে দিতে পারে। যেহেতু আক্কেল দাঁতের আসলে কোনো কাজ নেই।