শিশুর রক্তশূন্যতার কারণ কী? উত্তরঃ শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রাসেল সিদ্দিকী

শিশুদের রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়া বিষয়টি কী?

উত্তর : রক্তশূন্যতা বলতে একেবারেই রক্ত নাই বোঝায় না। শরীরে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ হিমোগ্লোবিনের অভাব থাকে,  তখনই তাকে রক্তশূন্যতা বলা হয়। সেই ক্ষেত্রে রক্তে সাধারণত লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ কম থাকলে, একটি শিশুর বয়সের তুলনায় বা ওজনের তুলনায় যদি রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে তাকেই রক্তশূন্যতা বলা ভালো।

প্রশ্ন : একটা শিশুর রক্তে অনেক উপাদান রয়েছে আমরা জানি। তার মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকা, হিমোগ্লোবিন- এগুলোর পরিমাণ কমে গেলে সমস্যা কী? এটাকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি কেন? এবং বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে এনিমিয়া হওয়ার প্রবণতা কেমন?

উত্তর : রক্তে হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া। আসলে রক্তে যখন হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ব্যহত হয়। সেই ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন :  কী ধরনের সমস্যা?

উত্তর : রক্তে যদি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে শরীরে অক্সিজেন কম পৌঁছে। এতে বিশেষ করে মস্তিস্ক বেশি আক্রান্ত হয়। মস্তিস্কে অক্সিজেনের পরিমাণ কম গেলেও শিশুটি অকারণে খিটখিটে মেজাজের হয়ে যেতে পারে। এটাকে আমরা বিরক্তভাব বলতে পারি। শিশুটি কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে। এই ক্ষেত্রে যারা স্কুলে পড়ুয়া শিশু তাদের ক্লাসে অমনোযোগিতা দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন : শিশুর বৃদ্ধিতে কী এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা কোনো প্রভাব ফেলে?

উত্তর : শিশুর দৈহিক এবং মানসিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রক্তশূন্যতা একটি বড় প্রভাব ফেলে। শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত করে। কারণ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য যে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়ে থাকে তা সাধারণত হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়।

প্রশ্ন : যে শিশুটি কথা বলতে পারে না, মা তার কী কী বিষয় দেখলে বুঝবেন শিশুটি এনিমিয়ায় ভুগছে?

উত্তর : সাধারণত শিশুটি ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে প্রথম উপসর্গ। মনে হচ্ছে ফর্সা হয়ে যাচ্ছে শিশুটি, আসলে সেটি নয়। তারপর দেখতে হবে শিশুটির কর্মচঞ্চলতা, তার খেলাধুলা স্বাভাবিক আছে, না কি আগের চেয়ে কমে গেছে। এরপর দেখতে হবে শিশুটির বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোনো অস্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করছে কি না। যেমন : কাগজ খাচ্ছে অথবা দেয়ালের রং তুলে তুলে খাচ্ছে-এই ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ তার মধ্যে দেখা দিচ্ছে  কি না। এরপরও খেয়াল রাখতে হবে, শিশুটি খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে কি না, স্বাভাবিক আচরণে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না।

প্রশ্ন : এরপর পরীক্ষা করে আপনারা বুঝেন তার রক্ত কতটুকু কমে গেছে। যদি রক্ত খুব বেশি কমে যায় তাহলে কী করেন?

উত্তর : সাধারণত বেশি কমে গেলে আমরা সিভিয়ার এনিমিয়া  বা গুরুতর রক্তশূন্যতা হিসেবে ধরে নিতে পারি। এ রকম এনিমিয়া হলে আমরা প্রথমে খেয়াল করব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না। শ্বাসকষ্ট থেকে হার্ট ফেইলিউর পর্যন্ত হতে পারে।

প্রশ্ন :  শিশু সাধারণত এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হয় কেন?

উত্তর : কারণ সাধারণত দেখা যাচ্ছে, শিশু গর্ভাবস্থায় থাকার সময় মায়ের যদি পুষ্টিহীনতা থাকে। মায়ের যদি কোনো  কারণে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে, মায়ের প্লাসেন্টায় যদি কোনো রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে, শিশুটি জন্মের পর যদি তার ওজন কম থাকে, যদি নির্দিষ্ট তারিখের অনেক আগেই জন্মগ্রহণ করে, সে ক্ষেত্রে মায়ের শরীর থেকে শিশুর গায়ে যে আয়রন যাওয়ার কথা সেটা পৌঁছায়নি-এসব কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।

প্রথম ছয় মাস শিশুর বুকের দুধ পান করার কথা। এরপর সময় থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য যেসব খাবার দেওয়ার কথা সেগুলো যদি না দেওয়া হয় তাহলেও এই সমস্যা হতে পারে।

প্রশ্ন : এনিমিয়া প্রতিরোধে শিশুকে কী কী খাবার দেওয়া যেতে পারে?

উত্তর : এই ধরনের শিশুর খাদ্যাভ্যাসে খিচুরি, মাংস, প্রচুর সবুজ শাক সবজি রাখলে এনিমিয়ার সম্ভবনা কমে যাবে।

প্রশ্ন : অনেক সময় আমরা দেখি রক্তের জটিল রোগ থেলাসেমিয়ার কারণেও এনিমিয়া হয়। এটার বিষয়টা কী?

উত্তর : থেলাসেমিয়া বংশগত বা বংশানুক্রমিকভাবে হতে পারে। থেলাসেমিয়ার কারণে রক্তে যে লোহিত কণিকা রয়েছে তার স্বাভাবিক আয়ুস্কাল কমে গিয়ে তার আগেই রক্তকণিকাগুলো ভেঙে যায়। এই কারণে রক্তে সাধারণত হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে সেসব উপসর্গ দেখা দেওয়ার কথা সেগুলো দেখা যায়। থেলাসেমিয়ার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে অত্যন্ত জরুরি লোহিতা রক্ত কণিকা তৈরির ক্ষেত্রে যে উত্তেজনার দরকার হয় সেখানে শারীর বৃত্তীয় পরিবর্তন দেখা যায়। এবং এনিমিয়ার লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। তার সাথে শিশুটির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হতে পারে। তার মুখমণ্ডলের বিভিন্ন পরিবর্তন হতে পারে। তার লিভার বড় হয়ে যেতে পারে।

প্রশ্ন : একটা সময় ছিল বাংলাদেশে এনিমিয়ার একটা কারণ হিসেবে বলা হতো কৃমি। এখন অবস্থা কী?

উত্তর : কৃমির মাধ্যমে যে রক্তশূন্যতা হয়ে থাকে সেটাকে আমরা বলি হুকওয়ার্ম। অন্ত্রের বিভিন্ন অংশে হুকওয়ার্ম কৃমি লেগে থাকার জন্য যে রক্তক্ষরণ হতে থাকে সেই জন্য বাচ্চার হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায় অথবা রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। আগে বলা হতো যেসব খোলা জায়গায় মলত্যাগ করা হয় সেখাকার সংস্পর্শে শিশু খালি পায়ে এলে তার শরীরে হুক ওয়ার্ম ঢুকতে পারে।

তবে নগরায়ণের জন্য এখন দেখা যায় এসব সমস্যা শিশুর বেশি হচ্ছে না। তবে গ্রাম দেশে বা দূরে যেখানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো নয় সেখানে হয়তো এই সমস্যা হয়।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রাসেল সিদ্দিকী। যিনি কর্মরত আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুরোগ বিভাগে।

 

source:ntv

Sharing is caring!

Comments are closed.