গর্ভাবস্থায় শরীরে পানি বা শরীর ফুলে যাওয়া এবং এ নিয়ে জরুরী পরামর্শ!
শরীরে পানি কেন আসে বা শরীর ফুলে যায় কেন?
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় শিশুর বৃদ্ধির কারনে প্রায় ৫০ ভাগ বেশী রক্ত ও তরল উৎপন্ন হয়। এই অতিরিক্ত রক্ত এবং তরলের কারণে গর্ভাবস্থায় শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যায়।
গর্ভাবস্থায় জরায়ুর আকার বাড়ার সাথে সাথে মায়েদের পেলভিক শিরা এবং ভেনা কাভাতে ( শরীরের ডান পাশে থাকা বড় শিরা যা শরীরের নিম্নাঙ্গ থেকে হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ করে) চাপ সৃষ্টি হয়। এর ফলে নিম্নাঙ্গ থেকে হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ কমে যায় যার ফলে শিরা থেকে তরল বের হয়ে টা শরীরের টিস্যুতে জমা হয়।
এই অতিরিক্ত তরল জমার ফলে শরীর নরম থাকে যাতে বাচ্চা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মায়ের শরীরও বড় হতে পারে। এই অতিরিক্ত তরল পেলভিক জয়েন্ট এবং টিস্যুগুলোকে বাচ্চা প্রসবের জন্য উপযোগী করে তোলে।
সাধারণত তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে শরীরে পানি আসা বা ফুলে যাওয়ার প্রবনতা দেখা দেয়। যাদের এমনিওটিক ফ্লুইড বেশী থাকে এবং গর্ভে যমজ সন্তান থাকে তাদের ক্ষেত্রে এর মাত্রা বেশী থাকতে পারে। সাধারণত দিনের শেষে বা গরম কালে এটি বেশী হতে পারে।
সন্তান প্রসবের পর দ্রুত ফোলা কমে যায় কারণ এ সময় অতিরিক্ত তরল শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়। প্রসবের পর কয়েক দিন এ কারণে অনেক ঘাম হয় এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
কখন ভয়ের কারন হতে পারে
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থায় শরীর ফুলে যাওয়া বা ইডেমা খুবই স্বাভাবিক। এতে ভয়ের কোন কারণ নেয়। বেশীর ভাগ মায়েরাই কম বেশী এ সমস্যায় ভোগেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইডেমা ভয়ের কারণ হতে পারে। যদি শরীর ফুলে যাওয়ার সাথে সাথে মাথা ব্যাথা থাকে এবং দৃষ্টি ঝাপসা মনে হয় তবে টা প্রি-এক্লাম্পশিয়ার লক্ষন হতে পারে। প্রি-এক্লাম্পশিয়ার হলে উচ্চ রক্তচাপ ও থাকবে। এটা সাধারণত গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পরে দেখা দেয় এবং তা অনেক বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। সাধারণত শরীর ফুলে যাওয়াতে কোন ভয়ের কারণ থাকেনা যদি না এর সাথে অন্যান্য লক্ষন দেখা না দেয়, যেমন- দম বন্ধ অনুভুতি, মাথা ব্যাথা, ঝাপসা দৃষ্টি, ফোলা অংশে ব্যাথা, ফুলে যাওয়া রক্তনালী ইত্যাদি। এছাড়াও হঠাত করে ফুলে যাওয়া বা বেশী ফুলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সাবধান থাকতে হবে।
আরেকটি ভয়ের কারণ হোল যদি শুধুমাত্র এক পা ফুলে যায়। যদি শুধু এক পা ফুলে যায় এবং কাফ ও থাই এ ব্যাথা অনুভূত হয় তবে তা রক্ত জমাট বাঁধার লক্ষন হতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধা বিপদজনক হতে পারে কারণে জমাট বাঁধা রক্তের কিছু অংশ ছিঁড়ে লাংসে চলে যেতে পারে এবং মৃত্যুও ঘটাতে পারে। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে গর্ভাবস্থায় রক্ত জমাট বাঁধতে পারে বিশেষ করে প্রথম ট্রাইমেস্টারে। তাই যখনি মনে হবে আপনার এক পা অন্য পায়ের চাইতে বেশী ফুলে আছে অতি সত্বর আপনার ডাক্তারকে জানান।
যদি ধূমপানের অভ্যাস থাকে, ওজন বেশী থাকে, বয়স ৩৫ বা তার বেশী হয় এবং পারিবারিক ইতিহাস থাকে তবে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেশী থাকে। তাই এ ধরনের কোন পারিবারিক ইতিহাস থাকলে তা অবশ্যয় আপনার ডাক্তারকে জানান।
এ ছাড়াও যদি মুখ ফুলে যায়, চোখের চার পাশে ফোলা থাকে, হাত বা পা অতিরিক্ত ফুলে যায় তবে অবশ্যয় সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় ফোলা কমাতে কি কি করা যেতে পারে?
- পায়ের উপর ভর দিয়ে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে না থাকার চেষ্টা করুনঃ
বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে বা পা নিচের দিকে মাটিতে রেখে বসে থাকলে শরীরের শিরার উপর চাপ পরে যার ফলে ফোলা আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে কিছুক্ষন পর পর কিছু সময় বসে থাকুন। বসার সময় পা কিছুর উপর তুলে রাখতে পারেন। আরামদায়ক জুতা ব্যাবহার করুন। টাইট জুতা বা লম্বা হীলের জুতার কারণে পা আরও বেশী ফুলে যেতে পারে।
- বিশ্রাম নেয়ার সময় পা উপরের দিকে তুলে রাখুনঃ
যখন বিশ্রাম নেবেন বা শুয়ে থাকবেন তখন পায়ের নীচে বালিশ বা আর কিছু দিয়ে পা উপরের দিকে তুলে রাখুন। এতে যেমন আপনার রিলাক্স হবে তেমনি এতে শরীরে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হবেনা। সবচাইতে ভালো হয় যদি শুয়ে থাকা অবস্থায় পা আপনার হার্টের চাইতে উপরে রাখা যায়। তবে যেটা আপনার জন্য আরামদায়ক সেটাই করুন।
- ঢোলা, আরামদায়ক এবং সুতির কাপর পরার চেষ্টা করুনঃ
গর্ভাবস্থায় ঢোলা এবং আরামদায়ক কাপড় পরার চেষ্টা করুন যাতে শরীর কোন চাপ না পরে। এ ছাড়াও সুতির কাপড় পড়লে অতিরিক্ত গরম লাগার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে। গরমের কারণে ইডেমা আরও বাড়তে পারে।
- নিয়মিত হাঁটাচলা বা ব্যায়াম করার চেষ্টা করুনঃ
ব্যায়ামের ফলে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে এবং অতিরিক্ত তরল দেহ থেকে বেড়িয়ে যায়। তবে কোন কোন ব্যায়াম গর্ভাবস্থায় আপনার জন্য উপযোগী সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করে নিন। নিয়মিত হাঁটাচলা করুন এবং মুভমেন্টে থাকার চেষ্টা করুন।
- আরামদায়ক এবং ঠাণ্ডা পরিবেশে ঘুমানোর চেষ্টা করুনঃ
আপনার শোওয়ার ঘর যাতে ঠাণ্ডা, আরামদায়ক এবং বাতাস চলাচলের ব্যাবস্থা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। বাম পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। এটা শরীরের ডান পাশে থাকা শিরায় চাপ কম পরে যা শরীরের নিম্নাংশ থেকে হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ করে। বিছানার চাদর যাতে সুতির কাপড়ের তৈরি হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। এতে ঘুমানোর সময় বেশী গরম লাগবেনা।
- খাবার লবনের পরিমান কম রাখুনঃ
অতিরিক্ত লবন শরীরে পানি ধরে রাখে। তাই খাবারে অতিরিক্ত লবন পরিহার করুন। সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন প্যাকেটজাত খাবার না খাওয়ার চেষ্টা করুন। অতিরিক্ত সোডিয়াম কমানোর আরেকটি উপায় হোল পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, যেমন- কলা, অ্যাপ্রিকট, কমলা, মিষ্টি আলু, বিট ইত্যাদি।
- প্রচুর পরিমানে পানি খানঃ
শরীরের অতিরিক্ত পানি কমানোর জন্য পানি খাওয়া তা আশ্চর্যের মনে হলেও গর্ভাবস্থায় এটা উপকারী। এতে আপনি যেমন হাইড্রেটেড থাকবেন তেমনি এর ফলে অতিরিক্ত তরল প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বেড়িয়ে যাবে। তবে চিনি সমৃদ্ধ পানীয়, যেমন সোডা বা প্যাকেটজাত জুস না খাওয়াই ভালো।
- অতিরিক্ত গরমে বাইরে না যাওয়ার চেষ্টা করুনঃ
অতিরিক্ত গরমে শরীর আরও বেশী ফুলে যেতে পারে। তাই গরমে বাইরে না যাওয়ার চেষ্টা করুন এবং ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক স্থানে থাকার চেষ্টা করুন।
- সাঁতার কাটুন বা পুলে হাঁটার চেষ্টা করুনঃ
সাঁতার কাটা খুবই উপকারী কারণ তে শরীরে রক্ত এবং তরল প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। যদি সাঁতার না পারেন তবে সুইমিং পুলে নেমে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। এতেও উপকার হয়।
- খাবারের দিকে নজর দিনঃ
গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবার চেষ্টা করুন। এতে শরীরে পানি আসার সমস্যা কমে যেতে পারে। ধুমপানের কারণে এ সমস্যা বাড়তে পারে তাই ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করুন।
- আক্রান্ত স্থানে মাসাজ করা যেতে পারেঃ
কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে মাসাজের ফলে শরীরে ফলে কমতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে বেশী জোরে মাসাজ করা না হয় যাতে ব্যাথা লাগে। এমনভাবে মাসাজ করা উচিত যাতে মাসাজের স্ট্রোকগুলো হার্টের দিকে হয়।
এছাড়াও গর্ভাবস্থায় উপযোগী কিছু কমপ্রেশন স্টকিংস, টাইটস এবং মোজা পাওয়া যায়। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সেগুলো ব্যাবহার করতে পারেন।
সবশেষে মনে রাখবেন ইডেমা বা শরীরে পানি আসা বা শরীর ফুলে যাওয়া গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক যদি না এর সাথে অন্য লক্ষনগুলো দেখা দেয়। তাই সতর্কতা জরুরী। গর্ভাবস্থায় সতর্কতা সুস্থ গর্ভধারণ এবং সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবের সম্ভাবনা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।
সুত্রঃ ইন্টারনেট