নবজাতককে কত ঘন ঘন এবং কতক্ষণ ধরে দুধ খাওয়াতে হবে?

কত ঘন ঘন এবং কতক্ষণ ধরে দুধ খাওয়াতে হবে?   সব শিশুর ক্ষেত্রেই এটি আলাদা, এবং শিশু কীভাবে জন্ম নিয়েছে তার উপরও এটি নির্ভর করে। জন্মের পর প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে একবার দুধ খেয়ে তার শুভসূচনা করার কথা। এরপর শিশুরা ঘুমিয়ে পড়তে পারে, এবং পরে আবার খেতে চাইলে আপনাকে বিভিন্নভাবে সংকেত দেয়ার চেষ্টা করবে।

অধকিাংশ নবজাতক শিশু ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৮ বার বা তারও বেশী খায়। বুকের দুধ খাওয়ানো আপনার শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি আরামদায়কও এবং আপনার ও আপনার শিশুর মধ্যে একটি ঘনষ্ঠি আবগের্পূণ সংযোগ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। শিশুদের কেউ কেউ নিয়মিত খাবার খায় এবং দ্রুত একটি রুটিন তৈরি করে নেয়, অন্যরা অনেক ঘনঘন, বিশেষ করে সন্ধ্যায় বা রাতে অল্প খাবার খেতে চায়। এটাকে গুচ্ছ খাবারগ্রহণ (ক্লাস্টার ফিডিং) বলা হয়। প্রথম কয়েক সপ্তাহে এটি খুবই স্বাভাবিক।

আপনার শিশু যখনই খাবার খাওয়ানোর ইঙ্গিত করে তাকে খাবার খাওয়ান। যতক্ষণ সে খেতে চায় তাকে ততক্ষন খাওয়ান। সে প্রথম স্তনের দুধ খাওয়া থামিয়ে দিলে, তার ঢেকুর উঠান এবং দ্বিতীয় স্তনটি থেকে খেতে দিন। এটি আপনার শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনার বুকের দুধের একটি ভাল সরবরাহ থাকা নিশ্চিত করবে। শিশুদের কেউ কেউ ২০ মিনিট ধরে খাবার খায়, অন্যরা অনেক লম্বা সময়ও নিতে পারে। আপনার শিশুও কিছু খাবার লম্বা সময় নিয়ে খেতে পারে এবং অন্য খাবারগুলো কম সময় নিয়ে খেতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার শিশু নিচের বিষয়গুলো করে ততক্ষন পর্যন্ত আপনার তার খাবার খাওয়ার সময় হিসাব করার বা তাকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

  • দিন ও রাত উভয় সময়ই ঘন ঘন অন্তত ২৪ ঘণ্টায় ৮ বার বা তার বেশি খাবার খায়।এটি স্বাভাবিক। শিশু দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে, একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
  • জোরে চুষে এবং গিলে খায়।
  • প্রচুর ভিজা এবং ময়লা ডায়াপার জমে।
  • যথাযথ ভাবে ওজন বাড়তে থাকে। জন্মের পর প্রথম কিছু দিন আপনার শিশুর ওজন হারানো স্বাভাবিক।

মনে রাখবেন, আপনার শিশুকে পর্যবেক্ষণ করুন, ঘড়িকে নয়।

শিশুদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তারা কতক্ষন বা কত ঘন ঘন খাবে তা পরিবর্তন করতে পারে। আপনার শিশুর ইঙ্গিতগুল অনুসরণ করুন। আপনার শিশু জানে কখন সে ক্ষুধার্ত এবং কখন তার পেট ভরা।

যখনই শিশু খাবার খেতে চায়, যেই স্তন সবচেয়ে বেশী পূর্ণ সেই স্তনটি দিয়ে শুরু করুন। এটা সাধারানত সেই স্তন যেটি থেকে সে তার শেষবার খাওয়া শেষ করেছিল। সে শেষবারের খাওয়ায় শুধু একটি স্তনে খেয়ে থাকলে, যে স্তনটি থেকে সে খায়নি সেটি দিয়ে শুরু করুন। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার শিশু খেতে আগ্রহী ততক্ষন পর্যন্ত তাকে খেতে দিন। অন্য স্তনে সরে যাবেন-

  • যখন প্রথম স্তনটি নরম অনুভূত হয়
  • আপনার শিশু আর সক্রিয়ভাবে চুষছে না
  • আপনার শিশু স্তন ছেড়ে দেয় বা ঘুমিয়ে পড়ে।

আপনার শিশুকে উভয় স্তন থেকে নিয়মিত দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করুন। আপনার শিশু দ্বিতীয় স্তন থেকে নেমে আসলে এবং তাকে তখন ক্ষুধার্ত মনে হলে প্রথম পাশটি আবার প্রদান করুন। আপনার শিশু দুধ খাওয়ার সময়ও আপনার স্তন দুধ তৈরি করা চালিয়ে যায়। খাওয়ানোর সময় শিশুকে প্রতিটি স্তন একাধিক বার প্রদান করা শুরুর দিকের দিন বা সপ্তাহগুলোতে বিশেষ করে উপকারী হতে পারে।

শিশুদের কেউ কেউ যখন তাদের খাওয়া শেষ হয়ে যায় স্তন ছেড়ে দেয়, অন্যরা ছাড়ে না। আপনার শিশু অনেকবার বিরতি নিলে এবং আর না গিললে, আপনি তাকে আপনার স্তন থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারেন। চোষায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য আপনার স্তন এবং শিশুর দাঁতের মাড়ির মধ্যে একটি আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিন। শিশুদের কেউ কেউ সবসময় উভয় স্তন থেকেই দুধ খায়, অন্যরা তা খায় না। শিশুদের কেউ কেউ স্বল্প সময়ের জন্য ঘুম দেয় এবং তারপর আবার স্তন থেকে খেতে চায়।

প্রতিবার খাওয়ানোর শুরতেই স্তন বদল করুন। মাঝে মাঝে মায়েরা বুঝতে পারেন কোনটি বেশি পূর্ণ। মহিলাদের কেউ কেউ তাদের অন্তর্বাসে ফিতা বা হাতে একটি বালা লাগনোর মাধ্যমে চিহ্ন রাখেন। আপনার এবং আপনার শিশুর জন্য যেটা কাজে করে সেটা করুন।

আপনার দুধ সরবরাহ ধরে রাখতে এবং কোন ফোলার/লাম্প, বদ্ধনালী এবং স্তনের প্রদাহের ঝুঁকি কমাতে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রতিবার খাওয়ানোতে একটি স্তন পুরো খালি করতে হবে। আপনার স্তনের আরাম অনুভব না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্তন থেকেই বাচ্চাকে খাওয়াতে থাকুন, তারপর দ্বিতীয় স্তন দিন। আপনার বাচ্চার বয়সের উপর, কতটা ক্ষুধার্ত তার উপর, কতক্ষণ আগে শেষবারের মতো খাওয়ানো হয়েছে, প্রথম স্তনে থাকা দুধের পরিমাণ এবং দিনের কোন সময়, এগুলোর উপর ভিত্তি করে আপনার বাচ্চা এক বা উভয় স্তন চাইতে পারে।

স্তনের সংকোচন

বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় নবজাতক শিশুদের কেউ কেউ সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে। আপনার শিশুর পেট না ভরা পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে অনুপ্রেরণা দিতে আপনি স্তনের সংকোচন ব্যাবহার করতে পারেন। আপনার দুধ প্রবাহিত হওয়ার জন্য সাহায্য করতে আপনার পাঁজর এবং স্তনের বোঁটার চারপাশের লালচে স্থানের মাঝখানে চাপ দিন যখনঃ

  • আপনার শিশু কয়েক মিনিট পরে স্তনে ঘুমিয়ে পড়ে।
  • সে কয়েকবার গেলা সহ হালকাভাবে চুষছে।
  • চোষাটি হালকা চোষা বা ঠোকরানোয় পরিবর্তিত হয়।
  • চোষা থেমে যায়।

আপনার পুরো হাত ব্যাবহার করুন এবং আলতো কিন্তু দৃঢ়ভাবে চাপ দিন। স্তনের সংকোচন কখনোই ব্যাথা দেয় না বা আপনার স্তনে কালশিটে ফেলে না। আপনি যখন চোষার মাঝখানে বা চোষার সময় আপনার স্তন সংকোচন করেন আপনার শিশু আরও বেশী গিলে কিনা দেখুন। এটি আপনার শিশুকে আরও বেশী দুধ পেতে সাহায্য করবে। যদি দুধের প্রবাহের পরিমান অত্যন্ত বেশি হয়, খাওয়ানোর পুরো সময় ধরে স্তনের সংকোচনের ব্যাবহার কোন কোন শিশুর জন্য সমস্যা হতে পারে। শিশুদের কেউ কেউ আবার স্তন প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অত্যাধিক দুধ প্রবাহের প্রয়োজন যখন হবে স্তনের সংকোচন কেবলমাত্র তখন ব্যাবহার করা যাবে। আপনার শিশুর চোষার ধরন পর্যবেক্ষণ করা উত্তম।

শিশু কি যথেষ্ট পরিমান দুধ পাচ্ছে?

প্রথম কিছুদিন অধিকাংশ শিশু কিছু ওজন হারাবে, কিন্তু তারপর তাদের ওজন বাড়তে শুরু করবে। আপনার শিশু যে পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে এগুলো হল তার লক্ষনঃ

  • আপনার শিশু প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৮ বার খায়। আপনার শিশু আরও ঘন ঘন খেলে তা ঠিক আছে। তার পেট ছোট, সেই কারণে তার বারব বার খাওয়ার প্রয়োজন হয়।
  • আপনার শিশুর চোষা খাওয়ার প্রথমে দ্রুততা থেকে মন্থরতায় পরিবর্তিত হয়। আপনি শিশুর গেলা শুনতে বা দেখতে সক্ষম হবেন। পরে খাওয়ার মধ্যে সে পুনরায় পরিবর্তন এনে দ্রুত চুষতে পারে।
  • চার দিন বয়সের পর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় আপনার শিশুর কমপক্ষে তিন বা চারটি মলত্যাগের ডায়াপার জমে। মলের রঙ হলুদ এবং দেখতে গাড় সুপের মত হয়। ছয় বা আট সপ্তাহ পর, সে বেশী ঘন ঘন মলত্যাগ নাও করতে পারে। এটি স্বাভাবিক।
  • আপনার শিশু সক্রিয় এবং তার জোরাল কান্নার আওয়াজ থাকবে।
  • আপনার শিশুর ভেজা, গোলাপি মুখ এবং উজ্জ্বল চোখ আছে।
  • শিশুর খাওয়ার পর আপনার স্তনগুলো নরম অনুভূত হবে।

দ্রুত বিকাশের পর্যায়

কোন কোন দিন শিশুদের স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ক্ষুধার্ত মনে হয়। এই সময়গুলোকে দ্রুত বিকাশের পর্যায় বলা হয়। যখন এটি ঘটে, মায়েদের কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে তাদের যথেষ্ট দুধ নেই। ঘন ঘন খাওয়ানো মানে এই নয় যে আপনার পর্যাপ্ত দুধ নেই বা আপনার দুধ যথেষ্ট নয়। আপনার শিশু যত বেড়ে ওঠে এমনও দিন থাকবে যখন সে সাধারন দিনের চাইতে বেশী ঘন ঘন খাবে। এই নিয়ে চিন্তার কোন কারন নেই। আপনার শিশুকে যত বেশী খাওয়াবেন তত বেশী দুধ উৎপন্ন হবে।

শিশুকে কতদিন বুকের দুধ খাওয়াবো?

জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে অন্যকোন খাবার ছাড়া শুধুমাত্র বুকের দুধ খাইয়ে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর যতদিন আপানার শিশু চায় ততদিন তাকে অন্যান্য খাবারের সাথে সাথে বুকের দুধ দেয়া চালিয়ে যান। বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনি শিশুর ২ বছর বয়স বা তারও পর পর্যন্ত তাকে বুকের দুধ দেয়া চালিয়ে যেতে পারেন।

শিশুকে যে কয়দিন বুকের দুধ দিবেন সে কয়দিনই আপনার ও শিশুর জন্য ভাল। কতদিন বুকের দুধ খাওয়াবেন তা আগেভাগে ঠিক করে নেয়ার দরকার নেই। অনেক মা-ই কাজে ফিরে গিয়ে বা আবার পড়াশোনা শুরু করার পরও শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে থাকেন।

আমি কি চুষনি বা পেসিফায়ার ব্যবহার করতে পারি?

কখনও কখনও মায়েরা শিশুদের দুই খাবারের মাঝে শান্ত করার জন্য চুষনি ব্যাবহার করে দীর্ঘ সময় পাওয়ার চেষ্টা করেন। এটি একটি সমস্যা হতে পারে কারণ শিশু এতে শিশু পর্যাপ্ত খাবার নাও খেতে পারে এবং আপনার স্তনগুলো কম দুধ তৈরি করতে শুরু করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে বুকের দুধ খাওয়ানোর আগে চুষনি ব্যবহার করলে দুধ খাওয়ার সময় কম লাগে। এটা মনে করা হয় যে ডামি এবং স্তনের ক্ষেত্রে বাচ্চার চোষণ পদ্ধতি ভিন্ন। এতে করে বুকের দুধ সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করতে পারে। বয়স্ক বাচ্চারা চুষনি এবং স্তনের পার্থক্য সনাক্ত করতে পারে।

যদি আপনি চুষনি ব্যবহারে মনস্থির করেন তাহলে আমরা সুপারিশ করবো বুকের দুধ খাওয়ানো পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বাচ্চার চুষনি প্রতিদিন পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করুন। চুষনি যখন ব্যবহার করবেন না তখন এটি কনটেইনারে রেখে দিন। আপনার মুখে কখনো চুষনি দিবেন না (“পরিষ্কার” করার জন্য) এবং চুষনির উপর কোন খাবার অথবা অন্য বস্তু (যেমন মধু) রাখবেন না।

আমার বাচ্চা বুকের দুধ খাচ্ছে না, আমি কী করতে পারি?

জন্মের ঠিক পর পর বেশিরভাগ বাবা-মা এই প্রশ্নটি করেন। এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আপনার শিশু যথা সময়ে খাওয়া শুরু করবে। পুরোটা সময় মায়ের শরীরের সাথে তার শরীর লাগিয়ে রাখুন। শিশুকে আপনার কাছে রাখুন এবং সে যখন প্রস্তুত হবে তখন সে চুষে খাওয়া শুরু করবে। কোনমতেই জোর করবেন না।

জন্মের ১২-২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও শিশু খাওয়া শুরু না করলে তা মায়ের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসময় ফিডারে করে খাওয়ানোর বদলে স্তন থেকে শালদুধ (কলোস্ট্রাম; colostrum) চেপে বের করে আঙ্গুলে নিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। যদি আপনার শিশু বেশিক্ষণ ধরে দুধ না খায়, কিন্তু নিয়মিত প্রস্রাব-পায়খানা করে তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এসময় ফর্মুলা মিল্ক বা চিনি মেশানো পানি খাওয়ানো শুরু করবেন না। এগুলোর কোন দরকার নেই এবং এতে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি বেশি হয়।

Source: fairy land

Sharing is caring!

Comments are closed.