বাচ্চাদের নেফ্রোটিক সিনড্রোম ও এর চিকিৎসা ! ডা. মো. হাবিবুর রহমান।

বাচ্চার প্রস্রাব কমে গেলে এবং শরীর ফুলে গেলে নেফ্রোটিক সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি কিডনির একটি জটিল রোগ। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগটি জটিল হয়ে গিয়ে এর চিকিৎসা করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে।

ডা. মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

প্রশ্ন : নেফ্রোটিক সিনড্রোম কী?

উত্তর : নেফ্রোটিক সিনড্রোম একটি কিডনি রোগ। এখানে প্রস্রাবের সঙ্গে এলবুমিন (এক ধরনের প্রোটিন) বেরিয়ে যায়।

প্রশ্ন : নেফ্রোটিক সিনড্রোম রোগের লক্ষণ কী?

উত্তর : নেফ্রোটিক সিনড্রোম সাধারণত দুই থেকে ছয় বছরের বাচ্চাদের হয়ে থাকে। বাচ্চার শরীর আস্তে আস্তে ফুলে যায়। ফোলাটা প্রথমে মুখমণ্ডলের দিকে শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায়। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। পেটে ব্যথা অনুভূত হয়। বাচ্চার অনেক সময় জ্বর হয়। কফ, কাশি হয়। শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কারণ নেফ্রোটিক সিনড্রমের কারণে ফুসফুসের পর্দায় পানি জমে যায়।

প্রশ্ন : নেফ্রোটিক সিনড্রোম কেন হয়?

উত্তর : বাচ্চাদের নেফ্রোটিক সিনড্রোমে ৯০ শতাংশের কোনো কারণ জানা যায় না। ১০ ভাগ হলো সেকেন্ডারি। মানে কোনো কারণের জন্য। কোনো সংক্রমণ থেকে নেফ্রোটিক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। যেমন : ম্যালেরিয়ার কারণে নেফ্রোটিক সিনড্রোম হতে পারে। সিফিলিসের কারণে হতে পারে। বাচ্চার যদি লিম্ফোমা, লিউকোমিয়া হয় -এসব কারণে এই সিনড্রোম দেখা দিতে পারে।

বিভিন্ন ওষুধের কারণে হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খাওয়ার জন্য নেফ্রোটিক সিনড্রোম হতে পারে। এমনকি পোকা, সাপ বা মৌমাছি কামড় দিলেও নেফ্রোটিক সিনড্রোম হতে পারে। তবে বাচ্চাদের ৯০ শতাংশ নেফ্রোটিক সিনড্রোম কোনো কারণ ছাড়াই হয়ে থাকে।

প্রশ্ন : কারণ ছাড়া যখন হঠাৎ করে এই সমস্যা হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত?

উত্তর : বাবা-মা যদি খেয়াল করে তার বাচ্চার প্রস্রাব কমে যাচ্ছে, শরীর ফুলে যাচ্ছে তখন পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্টের কাছে যাওয়া উত্তম। পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্ট মাকে শিখিয়ে দেবে কীভাবে অ্যালবুমিনটা প্রস্রাব থেকে বেরিয়ে যায়। মাকে শিখিয়ে দেওয়া হয় কীভাবে প্রস্রাব গরম করে পরীক্ষা করতে হয়। প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখবে গরম করার পর দইয়ের মতো তলানি জমে যাচ্ছে। অর্থাৎ অ্যালবুমিন বেরিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আরো কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে নেফ্রোটিক সিনড্রোম নিশ্চিত করতে হয়। শরীরে অ্যালবুমিনের পরিমাণটা দেখতে হবে। আমি আগেই বলেছি, নেফ্রোটিক সিনড্রোম হলে প্রস্রাবের সঙ্গে অ্যালবুমিন বেরিয়ে যাবে। যদি দুই দশমিক পাঁচ গ্রাম বা আড়াই গ্রামের নিচে নেমে যায়, কোলেস্টেরল যদি বেড়ে যায়, প্রতিদিন ২৪ গ্রামের বেশি যদি অ্যালবুমিন প্রস্রাব দিয়ে বেরিয়ে যায়, তখন আমরা বুঝব বাচ্চাটির নেফ্রোটিক সিনড্রোম হয়েছে। কিন্তু এরপর আনুষঙ্গিক আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।

নেফ্রোটিক সিনড্রোমের কিছু খারাপ লক্ষণ আছে। যদি প্রস্রাব দিয়ে লোহিত কণিকা যায়, তার যদি কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়, যদি প্রস্রাব লাল হয়ে যায়, বাচ্চার যদি বয়সের তুলনায় রক্তচাপ বেশি থাকে- এগুলোকে আমরা খারাপ লক্ষণ হিসেবে মনে করি। এগুলো হয়তো হিস্টোলজিক্যালই একটু খারাপ ধরনের নেফ্রোটিক সিনড্রোম।

প্রশ্ন : নেফ্রোটিক সিনড্রোমের চিকিৎসা কী?

উত্তর : এই রোগে প্রথমে সাধারণ চিকিৎসা করতে হয়। পরে নির্দিষ্ট চিকিৎসা করতে হয়। সাধারণ চিকিৎসা হলো যদি শরীর ফোলা নিয়ে আসে, তার পানি পানের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়ানো যাবে না। যেহেতু এখানে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায়। কোনো সংক্রমণ থাকলে, শরীরে প্রদাহ থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। শরীরে যদি অ্যালবুমিনের পরিমাণ খুব কমে যায়, তাহলে অ্যালবুমিন দিতে হবে। এরপর সংক্রমণ ভালো হয়ে যাওয়ার পর প্রধান চিকিৎসা হলো স্টেরয়েড।

যদি বারবার কোনো সমস্যা হয়, যদি বছরে চারবার বা তার চেয়ে বেশি হয়, তখন করটিকো স্টেরয়েডের সঙ্গে অন্য ওষুধও ব্যবহার করতে হবে। আর করটিকো স্টেরয়েডের অনেকগুলো ঝুঁকি আছে। বাবা-মা অথবা অভিভাবকদের আমরা আগে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো বুঝিয়ে দিই।

প্রশ্ন : সেই ক্ষেত্রে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

উত্তর : ওষুধের জটিলতা যদি বেশি দেখা দেয়, তখন স্টেরয়েডের সঙ্গে অন্য ওষুধ ব্যবহার করি। যাতে স্টেরয়েডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো বেশি দেখা না দেয়।

প্রশ্ন : নেফ্রোটিক সিনড্রোম প্রতিরোধে কী করা যায়?

উত্তর : নেফ্রোটিক সিনড্রোমের কোনো প্রতিরোধ নেই। আসলে ঠিক সময় চিকিৎসকের কাছে আসাই এক ধরনের প্রতিরোধ। হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর তার কী করণীয় এই সম্বন্ধে উপদেশ দিতে হবে।

প্রশ্ন : এই রোগ একবার হয়ে যাওয়ার পর কি আবার হওয়ার ঝুঁকি থাকে?

উত্তর : শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে বারবার হয়। সেই ক্ষেত্রে স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা সব সময়ই করতে হবে। স্টেরয়েডের সঙ্গে অন্য ওষুধগুলো আমরা ব্যবহার করি।

প্রশ্ন : সচেতনতা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে নেফ্রোটিক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে?

উত্তর : আমরা রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়ার সময় বলে দিই বাড়িতে প্রতিদিন প্রস্রাব করতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটি করতে বলি। কারণ এই রোগটি প্রায় ১৪ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত আবার ফিরে আসতে পারে। পরপর তিনদিন যদি প্রস্রাবে তলানি জমে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য বলে দিই। কারণ বাবা-মা যদি বাচ্চাকে দেরি করে নিয়ে আসে, আমরা দেখি অনেক সময় বাচ্চার সমস্ত শরীর প্রকাণ্ডভাবে ফুলে যায়। বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। তখন চিকিৎসা করা দুরূহ হয়ে পড়ে।

Source:ntv

Sharing is caring!

Comments are closed.