শিশুর জ্বর হতে পারে যেসব কারণে

জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়। এটি একটি উপসর্গ। শিশুদের জ্বর হলে এটি নিয়ে মা-বাবারা খুব উদ্বিগ্ন থাকেন। শিশুদের জ্বর হলে কী করবেন

প্রশ্ন : আমরা জানি, জ্বর একটি রোগের নাম। তার থেকে বড় বিষয় হলো এটি উপসর্গ হিসেবে কাজ করে। শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত কী কী ধরনের জ্বর হতে পারে?

উত্তর : জ্বর একটি উপসর্গ। এটি কোনো রোগ নয়। বিভিন্ন কারণে জ্বর হয়। সামান্য ব্যথা থেকেও জ্বর হতে পারে, গায়ে ফোঁড়া হলেও জ্বর হতে পারে। অধিকাংশ সময়ে আমরা জ্বরকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে একে তাড়াতাড়ি সারানোর চেষ্টা করি। আর অধিকাংশ শিশুর মা-বাবা জ্বরকে খুব ভয় পান। বিভিন্ন কারণে জ্বর হতে পারে। তার ভেতরে আমাদের শ্বাসকষ্টজনিত কারণ হতে পারে। ভাইরাল কোনো ইনফেকশনের কারণে জ্বর হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া জাতীয় কারণে জ্বর হতে পারে। অনেক সময় পেটের পীড়াজনিত ডায়রিয়ার কারণেও জ্বর হতে পারে। প্রস্রাবে ইনফেকশনের জন্য জ্বর হতে পারে।

প্রশ্ন : কী কারণে জ্বর হচ্ছে, জ্বরের মাত্রা দেখে এটি বোঝার কোনো উপায় আছে কি?

উত্তর : সাধারণত ভাইরাসজনিত জ্বরে প্রাথমিকভাবে জ্বরের মাত্রাটা অনেক বেশি হবে। তার সঙ্গে বাচ্চা অন্যান্য সমস্যার কথা বলবে, যেমন—মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা, শরীর ব্যথা এবং খিটমিটে স্বভাব ইত্যাদি দেখা যাবে। বাচ্চাটা সারাক্ষণ অস্বস্তি অনুভব করবে। জ্বর প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ দিলেই কমবে, স্বাভাবিক হবে। আবার জ্বরটা চলে আসবে। ভাইরাস জ্বরের লক্ষণ এ রকম। ব্যাকটেরিয়া জ্বরের জন্য প্রাথমিকভাবে এত উচ্চ মাত্রার জ্বর নাও হতে পারে। প্রাথমিকভাবে অল্প থাকবে। আস্তে আস্তে ব্যাকটেরিয়াগুলো শরীরে যত প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে, জ্বরের মাত্রাটা বাড়তে থাকবে। যেমন ধরুন, সকালে জ্বর রয়েছে ১০০, বিকেলে হয়তো ১০১, পরের দিন ১০২। এভাবে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। জ্বরের মাত্রা কমবে না। হয়তো প্যারাসিটামল দিলে কমবে, তবে আবার জ্বর আসবে। এই জ্বরটা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। এ রকম আমরা অনেক সময় টাইফয়েড জ্বরের ক্ষেত্রে দেখে থাকি। এগুলোই ভাইরাস আর ব্যাকেটিয়ার জ্বরের ভেতর পার্থক্য।

আর অন্যান্য জ্বরের ভেতরে যদি পেটের কোনো সংক্রমণ হয়, তখন বিষাক্ত জীবাণু দিয়ে আমাদের জ্বর আসতে পারে। এ ছাড়া গায়ে কোনো ফোঁড়া হলে জ্বর আসতে পারে।

প্রশ্ন : ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জ্বরের লক্ষণ হয়তো শুরুর দিকে একই রকম। সে ক্ষেত্রে শিশুদের জ্বর হলে অভিভাবকদের করণীয় কী?

উত্তর : সে ক্ষেত্রে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে শিশুদের প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। তবে সঠিক ডোজে। এ ক্ষেত্রে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা উত্তম। আমি বলব, বাচ্চাদের তিন থেকে চার দিন প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ খাইয়ে দিতে হবে। আর সারা গা কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে মুছিয়ে দিতে হবে। একদমই ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা যাবে না।

প্রশ্ন : এ বিষয়ে আমি একটু জানতে চাইছিলাম, জ্বর হলে অনেকে ঠান্ডা পানি দিয়ে গা মোছেন। ভাবেন, জ্বর গরম, তাই ঠান্ডা পানি ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়ে কিছু বলুন?

উত্তর : এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ঠান্ডা পানি ব্যবহার করলে বাচ্চার গা তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হবে। আসলে এত ঠান্ডা বাচ্চা গ্রহণ করতে পারে না। তখন বাচ্চা আরো কষ্ট পায়। ঠান্ডাকে সে গ্রহণ করতে চায় না। এ জন্য আমরা পানিকে একটু কুসুম কুসুম গরম করে নিতে বলি, যাতে বাচ্চাটা শরীরে সেটা গ্রহণ করতে পারে। তাই আমরা পরামর্শ দিই ঠান্ডা পানিকে এড়িয়ে যেতে।

প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, তিন দিন পর্যন্ত প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে এবং গা মুছিয়ে দিতে হবে। এর পরও যদি জ্বর থেকে যায়, তখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আপনাদের কাছে গেলে কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন এটি আসলে কোন ধরনের জ্বর?

উত্তর : ভূগোল অনুযায়ী একেক দেশে একেক রোগের প্রকোপ বেশি। আমাদের দেশেও এলাকাভিত্তিক কিছু জ্বর রয়েছে। যেমন পাহাড়ি অঞ্চলে জ্বর হলে আমরা ম্যালেরিয়ার কথা চিন্তা করব। আবার ঢাকায় খুব প্রচলিত হলো ডেঙ্গু জ্বর। ঢাকার বাইরে এই জ্বর এত হয় না। একেকটি জ্বরের ক্ষেত্রে ইতিহাস দিয়ে রোগ নির্ণয় করতে হবে। দেখতে হবে, কীভাবে জ্বরের লক্ষণ শুরু হয়েছে। এখন কীভাবে সে চলছে। একেকটি জ্বরের একেকটি লক্ষণ, শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ে আমাদের সহায়তা করে এই লক্ষণ। আর ২০ ভাগ রয়েছে, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অন্যান্য কিছু দিয়ে নিশ্চিত হই।

প্রশ্ন : জ্বর এলে এর মাত্রাটা কি নোট করে রাখতে হবে?

উত্তর : আমি অনুরোধ করব, জ্বরের মাত্রাটা কত উঠে, সেটি লিখে রাখতে। এটি লিখে রাখা খুব জরুরি। অনেক সময় গায়ে হাত দিয়ে অনুভব করি গা গরম। তবে থার্মোমিটার দিয়ে মাপলে আর তেমন জ্বর পাওয়া যায় না। ১০০-এর মতো হলে আমরা সেটাকে জ্বর হিসেবে চিন্তা করব। তিন দিন পর এলে, যদি কাশি হয় আমরা দেখব ফুসুফুসের কোনো সমস্যা আছে কি না। নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কিউলাইটিস আছে কি না আমরা দেখব। অন্যান্য কারণে যদি হয়ে থাকে, যেমন—পেটব্যথা থাকে, মাথাব্যথা থাকে অথবা তার জিহ্বাটা পরীক্ষা করে দেখব সাদা, তখন টাইফয়েড বা অন্য কিছু আছে কি না সেটি চিন্তা করব। ভাইরাল জ্বরের জন্য ডেঙ্গু প্রচলিত রোগ। এটি হলো মাথাব্যথা কতটুকু সেটি দেখব। তার মাথাব্যথা করছে কি না, ঘাড়ে ব্যথা করছে কি না, তার সঙ্গে বাচ্চার অন্য কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, সেগুলো দেখব। অনেক সময় চার-পাঁচ দিন পার হলে পায়খানা কালো বা প্রস্রাবের রং একটু পরিবর্তন হয়, এগুলো খেয়াল করতে হবে।

প্রশ্ন : চিকিৎসাটা কীভাবে দেন তখন?

উত্তর : জ্বরের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করি। ডেঙ্গুর জন্য এখন অনেক ধরনের চিকিৎসা রয়েছে।

প্রশ্ন : আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একদিন যেতে না-যেতেই মা-বাবারা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন এবং অ্যান্টিবায়োটিক যদি দেওয়া না হয়, বোধ হয় সন্তুষ্ট হতে পারেন না। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

উত্তর : আমি ঢাকায়ও প্র্যাকটিস করি, ঢাকার বাইরে গ্রামেও রোগী দেখি। সেখানেও এটি প্রচলিত একটি সমস্যা। আমাদের দেশের চিকিৎসকরাও প্রভাবিত হয় মা-বাবার কথায়। যে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চান না, তার কাছে একবার-দুবার গিয়ে আর যান না। বলেন, তিনি তো ওষুধ দেন না। তাঁরা চিকিৎসকদের প্রভাবিত করেন। বলেন, এমন কিছু করেন যেন জ্বর আজকের মধ্যে বা এক-দুদিনের মধ্যে সেরে যায়। মা-বাবা তো আসলে উদ্বিগ্ন থাকবেনই। তাদের সহানুভূতি দিতে হবে। তবে চিকিৎসার বিষয়ে কোনো আপস করা যাবে না। তার যেটি রোগ, সেটির চিকিৎসা করতে হবে। যদি সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়, আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। তবে ভাইরাস জ্বরের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রভাবিত হয়ে যাই। আসলে রোগীরা তো উদ্বিগ্ন থাকবেই। তাকে নিশ্চিত করাও চিকিৎসারই অংশ। তাকে বোঝাতে হবে, আপনার বাচ্চার জ্বর ভালো হবেই। তবে আপনাকে দুই-তিন দিন সময় দিতে হবে। আর যেকোনো রোগেরই একটি আদ্যোপান্ত রয়েছে। এখানে আপনাকে একটু অপেক্ষা করতেই হবে। তাই বাচ্চার অভিভাবককে বোঝাতে হবে। আর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন যেখানে রয়েছে, সেখানে দিতে হবে। অনেক সময় জ্বরের প্রথম দিকেই শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়া নিয়ে আসে, তখন অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। তবে সেটিও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের পরামর্শক ডা. মো. কবীর হোসেন 

sourch:ntv

Sharing is caring!

Comments are closed.