শিশুদের জটিল রোগ নেফ্রোটিক সিনড্রম, বিস্তারিত বলছেন শিশু ও শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান।
প্রশ্ন : নেফ্রোটিক সিনড্রম এই নামটি দিয়ে কোন রোগটিকে বোঝানো হয়?
উত্তর : নেফ্রোটিক সিনড্রম বাচ্চাদের একধরনের কিডনির রোগ। এই রোগ বয়স্ক লোকদেরও হতে পারে। এই রোগে শরীরে এলবুমিন নামে যে প্রোটিন আছে কিডনির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছাঁকনি দিয়ে সেটা বের হয়ে যায়। এলবুমিনের কাজ হলো শরীরে জলীয় পদার্থ ধরে রাখা। এলবুমিন যদি বেরিয়ে যায় শরীর ফুলে যায়। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে। প্রথম পানিটা জমে মুখে। এরপর সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায়।
প্রশ্ন : সাধারণত কোন বয়সের শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়?
উত্তর : দুই থেকে ছয় বছরের শিশুরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। নেফ্রোটিক সিনড্রমে শরীরে তিনটি ঘটনা হয়। এলবুমিন বেশি পরিমাণে বেরিয়ে যায়। প্রতিদিন প্রতি মিটার স্কয়ার সারফেস এলাকা অনুযায়ী এক গ্রামের বেশি এলবুমিন বেরিয়ে যায়, শরীরে যদি ২৫ গ্রাম পার লিটারের থেকে এলবুমিন কমে যায় এবং শরীর ফুলে যায়, শরীরে যদি চর্বির পরিমাণ ২২০ মিলিগ্রামের বেশি বেড়ে যায়, সেই রোগকে আমরা নেফ্রোটিক সিনড্রম বলি।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে যখন রোগীরা আসে, তখন কী কী অভিযোগ নিয়ে আসে?
উত্তর : একটা নেফ্রোটিক সিনড্রম রোগী বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। দেখা যায় শিশুটির সমস্ত শরীর ফুলে গেছে, জ্বর এসেছে, পেটে ব্যথা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চা খিঁচুনি নিয়ে এসেছে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে এসেছে। এই লক্ষণগুলো সাধারণত থাকে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন শরীরটা ফুলে যায়, কত সময় ধরে এই ফোলাটা চলতে পারে?
উত্তর : আস্তে আস্তে, কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে ফোলে। একই ধরনের আরেকটি রোগ আছে যাকে বলে একিউট গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস, এই রোগে শরীর হঠাৎ ফুলে ওঠে।
প্রশ্ন : যখন ফুলে যায় এবং আপনাদের কাছে রোগী আসে তখন কী দেখে আপনারা নিশ্চিত হন এটা নেফ্রোটিক সিনড্রম?
উত্তর : প্রথমে আমরা তার প্রস্রাবটা পরীক্ষা করি। প্রস্রাব একটা টেস্ট টিউবের মধ্যে নিয়ে গরম করি। তখন দেখা যায়, দইয়ের আকারে একটা তলানি জমে গেছে। সম্পূর্ণ টেস্ট টিউবেই যদি এমন তলানি জমে, তখন ধরে নিই ৪+ এলবুমিন যাচ্ছে। সম্পূর্ণ টেস্ট টিউবের থেকে একটু কম ৩+। সুতরাং আমরা প্রস্রাবের পরীক্ষা করি এবং কিছু রক্তের পরীক্ষা করি। যদি ২৫ গ্রামের থেকে কম হয় তখন ধরে নেই তার নেফ্রোটিক সিনড্রম আছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি এক গ্রামের বেশি এলবুমিন যায় তখন আমরা ধরে নিই তার নেফ্রোটিক সিনড্রম হয়েছে।
প্রশ্ন : যখন নিশ্চিত হন তার নেফ্রোটিক সিনড্রম হয়েছে। তখন কীভাবে চিকিৎসা করেন?
উত্তর : এর চিকিৎসাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। একটা সাধারণ চিকিৎসা আরেকটা নির্দিষ্ট চিকিৎসা। শরীর যেহেতু ফুলে যায় আমরা মাকে বলি ফোলাটা যাতে আর না বাড়ে, তাই নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি খাওয়াতে। শরীর যেন পানি ধরে না রাখে তাই লবণ বেশি খাওয়ানো যাবে না। রান্নাতে শুধু লবণ দেবে, বাড়তি লবণ খাওয়া যাবে না। পানির পরিমাণটুকু আমরা দেখিয়ে দিই।
প্রশ্ন : নির্দিষ্ট চিকিৎসাটা কীভাবে করেন?
উত্তর : প্রথমবার যদি নেফ্রোটিক সিনড্রম নিয়ে আসে তখন পেডনিসোলন দিই। একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করা হয়। প্রথমবার তিন মাসের চিকিৎসা করা হয়।
প্রশ্ন : চিকিৎসার পর তার কী উন্নতি হয়েছে সেটি বোঝার জন্য ফলোআপে কখন আসতে বলেন?
উত্তর : উন্নতির কতগুলো লক্ষণ আছে। প্রথমে দেখি তার প্রস্রাবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে কি না। যে সমস্ত বাচ্চার উন্নতি হয়েছে, তার শরীরে ফোলাটা কমে যাবে। সে প্রচুর প্রস্রাব করবে। তার জ্বর থাকবে না। বাচ্চাটা উৎফুল্ল হবে। তখন আমরা বুঝি বাচ্চাটি বাড়িতে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ রকম সুস্থ।
প্রশ্ন : যদি কোনো কারণে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া না হয়, সে ক্ষেত্রে এর জটিলতা কী কী হতে পারে?
উত্তর : সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। পেরিটোনাইটিস, এই রোগে শরীরে সংক্রমণ হয়। মূত্রনালির প্রদাহ, ফুসফুসের মধ্যে পানি জমে যাওয়া হতে পারে। এ ছাড়া শিরার মধ্যে থ্রম্বোসিস হতে পারে। রোগ জটিল হয়ে গেলে মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে।
প্রশ্ন : প্রথম পর্যায়ের চিকিৎসাটা প্রথম তিন মাসের মধ্যে হয়ে যায়। পরে আপনারা আবার কখন চিকিৎসা শুরু করেন?
উত্তর : নেফ্রোটিক সিনড্রম কী কারণে হয়, এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিকরা জানতে পারেননি। তাই তার সারা জীবনের মতো ভালো হয়ে যাওয়ার চিকিৎসাও আবিষ্কার হয়নি। সৌভাগ্য হলো, বাচ্চাদের নেফ্রোটিক সিনড্রম এবং বয়স্কদের এই অসুখের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। বাচ্চাদের অসুখটি সাধারণত ১৪ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি হলে আবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মাকে আমরা উপদেশ দিই প্রতিদিন বাড়িতে প্রস্রাব পরীক্ষা করার জন্য। পরপর তিনদিন যদি প্রস্রাব আগের মতো তলানি জমে, তখন চিকিৎসকের কাছে আসতে বলি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু ও শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান।
সোর্সঃএনটিভি