প্রসব আরম্ভের লক্ষন সমূহ
গর্ভের মোট সময় কাল ধরা হয় ৪০ সপ্তাহ বা ২৮০ দিন বা ঌ মাস ৭ দিন৷ শেষ মাসিকের প্রথম দিনটিকে গর্ভধারনের প্রথম দিন ধরে প্রসবের তারিখ নির্ধারন করা হয়ে থাকে৷ যেমন – গর্ভধারণের শেষ মাসিকের প্রথম দিন যদি ২০ ডিসেম্বর হয় তবে প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ হবে ২৭ সেপ্টম্বর৷ এ ক্ষেত্রে প্রতি মাসকে ৩০ দিন হিসেবে ধরা হয়৷ প্রসবের প্রস্তুতির জন্য এভাবে প্রসবের তারিখ নির্ণয় করা যায়৷ এই তারিখের ২ সপ্তাহ আগে বা পরে যে কোনও তারিখে সাধারণত প্রসব হয়ে থাকে৷
প্রসব আরম্ভের লক্ষণ
প্রসব শুরু হওয়ার ৪টি লক্ষণ রয়েছে
প্রসব বেদনা ও সঙ্গে সঙ্গে জরায়ুর সংকোচন
যোনীপথে রক্ত মিশ্রিত স্রাব বের হওয়া
জরায়ুর মুখ খুলে যাওয়া
পানিপূর্ণ থলি
প্রসব বেদনা
একজন গর্ভবতীর প্রসব বেদনা ছাড়াও অন্যান্য অনেক কারণে পেটে ব্যথা হতে পারে৷ প্রসব বেদনা হলে ব্যথার সঙ্গে জরায়ুও সংকুচিত হবে৷ জরায়ুর সংকোচন হচ্ছে কিনা বোঝার উপায় হচ্ছে, যখন ব্যথা হয় ঠিক তখনই জরায়ুও সংকুচিত হয়৷ তখন পেটে হাত দিলে অনুভব করা যাবে যে জরায়ু শক্ত হয়ে আছে৷ আর ঠিক তার পরক্ষণেই যখন ব্যথা নেই অর্থাত্ জরায়ু স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে তখন পেটে চাপ দিলে হাতে অনুভব করা যাবে যে জরায়ু নরম হয়ে আছে৷ প্রসব বেদনার আরো একটি চরিত্র আছে৷ এই ব্যথা একবার আসে আর চলে যায়, আবার আসে৷ এটা বারবার হতে থাকে৷ সময় যত যায় বেদনার তীব্রতা তত বাড়তে থাকে এবং দুই ব্যথার মাঝখানে বিরতির সময়ও কমে আসতে থাকে৷ প্রসব বেদনা শুরু হয় পিঠের দিকে এবং ধীরে ধীরে তা সামনের (উরুর) দিকে এগিয়ে আসে৷
যোনিপথে রক্ত মিশ্রিত স্রাব নির্গমণ
প্রসব বেদনা শুরু হলে যোনিপথ থেকে অল্প অল্প পরিমাণ রক্ত মিশ্রিত স্রাব বের হতে থাকে৷ একে চিকিত্সা পরিভাষায় শো বলে৷ গর্ভাবস্থায় জরায়ুর মুখ সাধারণত ঢাকা থাকে৷ ঢাকনাটি জরায়ুর মধ্যের শিশুটিকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে৷ এই ঢাকনাটি প্রসবের আগে খুলে বেরিয়ে আসে এবং তখনই এই রক্তস্রাব শুরু হয়৷
জরায়ুর মুখ খুলতে থাকা
গর্ভকালে জরায়ু মুখ পুরোপুরি বন্ধ থাকে কিন্তু প্রসব বেদনা শুরু হলেই জরায়ুর মুখ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে৷
পানিপূর্ণ থলি
গর্ভস্থ শিশু একটি থলির মধ্যে থাকে৷ থলিটা একটি বিশেষ জলীয় পদার্থে ভর্তি থাকে৷ প্রসবকালে জরায়ুর মুখ খুলে গেলে গর্ভফুলের পর্দা কিছু পরিমাণ ঐ জলীয় পদার্থসহ জরায়ুর মুখ দিয়ে দিয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ে৷ শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বে এই পানির থলি ভেঙে যায় এবং যোনিপথে পানির মতো জলীয় পদার্থ বের হয়ে আসে৷
স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়া
প্রসবের তিনটি স্তর থাকেঃ
প্রথম স্তর
প্রসবের প্রথম স্তর হলো প্রসব বেদনা শুরু হওয়া থেকে জরায়ুর মুখ সম্পূর্ণ খুলে যাওয়া পর্যন্ত সময় বা অবস্থা৷ প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে প্রথম জরায়ুর মুখ খুলতে সময় লাগে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টার মতো৷ দ্বিতীয় বা পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে৷
দ্বিতীয় স্তর
জরায়ুর মুখ সম্পূর্ণভাবে খোলা থেকে শিশু সম্পর্ণ ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত সময় বা অবস্থা৷ এই সময় পানির থলি ফেটে যায় এবং শিশু জরায়ু থেকে প্রসব পথে ভূমিষ্ট হয়৷ প্রসবের এই স্তর সম্পন্ন হতে ২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না৷
তৃতীয় স্তর
শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর গর্ভফুল বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সময় বা অবস্থা৷ সাধারণত ৫ মিনিট থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে গর্ভফুল বেরিয়ে আসে৷ গর্ভফুল বের হওয়ার পরে দেখা উচিত তা সম্পূর্ণরূপে বের হয়েছে কিনা৷ গর্ভফুলের কোনও অংশ ছিঁড়ে জরায়ুতে রয়ে গেলে প্রসূতিকে নিকটতম স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে৷ প্রসবের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে অর্থাত্ প্রসব বেদনা শুরু হওয়া থেকে গর্ভফুল বের হওয়া পর্যন্ত প্রথম গর্ভবতীর জন্য সময় লাগে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় বা তার পরের গর্ভবতীর সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা সময় লাগে৷ এই সময়ের মধ্যে প্রসব সম্পন্ন না হলে গর্ভবতীকে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে ৷
অস্বাভাবিক প্রসব
স্বাভাবিক প্রসবের ব্যতিক্রম যে কোন প্রসবকে অস্বাভাবিক প্রসব বলা যায়৷ গর্ভস্থ ভ্রূণের সংখ্যা, অস্বাভাবিক অবস্থান অস্বাভাবিক প্রসবের কারণ৷ অস্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থাপনা হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করতে হবে৷ তাই রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷ নিম্নে কিছু অস্বাভাবিক প্রসব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো৷ গর্ভস্থ শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থানপ্রসবের সময় জরায়ুতে শিশুর অবস্থানের ওপর প্রসবের সুবিধা-অসুবিধা নির্ভর করে৷ শিশুর মাথাটি যদি নিচের দিকে অর্থাত্ জরায়ুর মুখে থাকে তাহলে তা স্বাভাবিক অবস্থা৷ কখনো কখনো আবার মাথা নিচের দিকে না থেকে শিশুর দেহের অন্য অংশও নিচের দিকে থাকতে পারে৷ এগুলোকে অস্বাভাবিক অবস্থান বলে এবং এগুলো অস্বাভাবিক প্রসবের কারণ৷ অস্বাভাবিক অবস্থা অনেক রকম হতে পারে-
* শিশুর নিতম্ব জরায়ুর মুখে ও মাথা ওপর দিকে থাকলে
* শিশুটি জরায়ুতে আড়াআড়িভাবে থাকতে পারে
* শিশুর মুখ নিচের দিকে থাকতে পারে
গর্ভে যমজ শিশু
একই গর্ভকালে জরায়ুর ভেতরে একটির পরিবর্তে দুটি সন্তান হলে তাকে যমজ সন্তান বলে৷ এক্ষেত্রে গর্ভবতীর পেট স্বাভাবিকের চেয়ে বড় থাকে, পেট হাত দিয়ে পরীক্ষা করলে দু’টো মাথা বুঝতে পারা যায়৷ যমজ সন্তান নিশ্চিত হলে প্রসূতিকে অবশ্যই প্রসবের জন্য হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠাতে হবে৷ কারণ যমজ সন্তানের প্রসবে অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে৷
দীর্ঘস্থায়ীপ্রসব
যদি কোন কারণে প্রথম গর্ভের ক্ষেত্রে প্রসবে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে এবং দ্বিতীয় বা তার পরের গর্ভের ক্ষেত্রে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে তবে তাকে দীর্ঘস্থায়ী প্রসব বলে৷ গর্ভে সন্তানের অবস্থান অস্বাভাবিক হলে, বস্তিকোটরের হাড়ের গঠন অস্বাভাবিক হলে, গর্ভবতীর মারাত্মক অপুষ্টি থাকলে প্রসব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে৷ এ অবস্থায় রোগীকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে৷ আমাদের দেশে গর্ভবতী মায়ের মৃতু্য, মৃত প্রসব ও শিশু মৃতু্যর একটি অন্যতম কারণ দীর্ঘস্থায়ী প্রসব৷ সময়মত রোগীকে হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র পাঠলে মা ও শিশুর মৃতু্যহার অনেকাংশে কমানো সম্ভব৷
ঔষুধ সেবন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে রেজিষ্টার চিকিত্সকের পরামর্শ নিন৷
তথ্যসুত্র-ড্রাগ ডিরেক্টরী,
ডা. সুমন চৌধুরী :
কৃতজ্ঞতাঃ Fairy land