শিশুর ল্যাকটোজ অসহনীয়তা : কী করবেন?
তবে কোনো কোনো শিশুর ক্ষুদ্রান্ত্র পর্যাপ্ত পরিমাণ ল্যাকটোজ উৎপন্ন করতে না পারায় তারা যখন দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খায়, তখন তাদের ক্ষুদ্রান্ত্র একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখানে অপর্যাপ্ত ল্যাকটোজ এনজাইম ও ল্যাকটোজধর্মী চিনির যুদ্ধ শুরু হয়। এতে শিশুর বিভিন্ন সমস্যা, যেমন—ঘন ঘন পাতলা পায়খানা, পেট ফোলা, পেট ফাঁপা ইত্যাদি দেখা দেয়। একেই বলা হয় ‘ল্যাকটোজ অসহনীয়তা’। প্রত্যেক মানুষই জন্মের সময় দুধ হজমের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। তবে কারো কারো শৈশব অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে ল্যাকটোজ এনজাইম উৎপাদনের ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। কখনো কখনো এই হ্রাসপ্রাপ্তি এত ধীরে ঘটে যে এর জন্য তরুণ বয়স পর্যন্ত কোনো বিশেষ উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে সুখের কথা হলো, একবার ল্যাকটোজ অসহনীয়তা শনাক্ত করতে পারলে তা সহজে এবং সাফল্যজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখানে তার কতগুলো উপায় বর্ণনা করা হলো :
খাদ্যের লেবেল পড়ার অভ্যাস করতে হবে
যদি শিশুর ল্যাকটোজ অসহীয়তা খুব বেশি মাত্রায় হয়ে থাকে, তাহলে সব সময় শিশুকে যে খাবারটি কিনে খাওয়াতে চাইছেন, তার লেবেল পড়ার অভ্যাস করতে হবে। কেননা দুধ, পনির, আইসক্রিম ইত্যাদি ছাড়া অন্য খাবারেও ল্যাকটোজ থাকতে পারে। তাই খাবারের মোড়কে লেখা উপাদানগুলো ভালো করে পড়ে দেখতে হবে তাতে কেসিন, ননি, ল্যাকটোজ, দুধ ইত্যাদি আছে কি না। থাকলে তা শিশুকে খাওয়ানো যাবে না। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেও বাবুর্চিকে বলে দিতে হবে যেন উপরোক্ত উপাদান-সংবলিত খাবার শিশুকে না দেয়।
একটি খাদ্যপঞ্জিকা রাখতে হবে
একটি ডায়েরিতে শিশু দৈনিক যা খাচ্ছে, তার তালিকা এবং এতে যদি কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তা লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। এতে বোঝা যাবে, কোন ধরনের খাদ্য শিশুর কী ধরনের অসুবিধা করছে।
সাবধানতার সঙ্গে পরীক্ষা চালাতে হবে
একেকজনের সহ্যক্ষমতা একেক রকম। এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমে এর তীব্রতা যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে শিশুকে অল্প করে ল্যাকটোজ-সংবলিত খাবার খাওয়াতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়াতে হবে। এভাবে দেখতে হবে শিশু সর্বোচ্চ কতটুকু ল্যাকটোজ কোনো প্রকার উপসর্গ ছাড়া গ্রহণ করতে পারে।
শিশুকে খাওয়ানোর ওষুধের উপাদানগুলো জেনে নিন
এমন অনেক কিছুতে ল্যাকটোজ থাকতে পারে, যা হয়তো শিশুর পিতামাতা কল্পনাও করবেন না, তার মধ্যে একটি হলো ওষুধ। অনেক ওষুধে গাঠনিক উপাদান হিসেবে ল্যাকটোজ থাকে। তাই শিশুকে তার প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোর আগে অথবা ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনার আগে অবশ্যই লেবেল পড়ে দেখে নিতে হবে তার মধ্যে ল্যাকটোজ আছে কি না।
শিশুকে শুধু ল্যাকটোজ-সংবলিত খাবার দেওয়া যাবে না
শিশুর ল্যাকটোজ সহনীয়তা পরীক্ষা করার সময় তাকে এককভাবে ল্যাকটোজ-সংবলিত খাবার না দিয়ে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে তা খাওয়াতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শুধু দুধ খেতে দিলে শিশুর হজমে যতটা অসুবিধা হবে, তার চেয়ে অনেক কম অসুবিধা হবে যদি দুধের সঙ্গে বিস্কুট, সেরিয়াল ইত্যাদি দেওয়া হয়।
ল্যাকটোজের পরিমাণ কম আছে এমন খাবার শিশুর জন্য বেছে নিন
দুধে ল্যাকটোজের পরিমাণ বেশি থাকায় তা শিশুর হজমে বেশি অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে শক্ত পনিরে ল্যাকটোজের পরিমাণ বেশ কম থাকে। আবার আইসক্রিমে থাকে মাঝামাঝি পরিমাণের ল্যাকটোজ। ঘরে তৈরি দইয়ে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া নিজেই দইয়ের অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া হজম করে রাখে। তাই সেটি খেলেও শিশুর অসুবিধা মোটামুটি কম হবে। এত সব বিবেচনা করে ও শিশুর ল্যাকটোজ সহনশীলতার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে শিশুর জন্য সঠিক খাবার নির্বাচন করতে হবে।
ল্যাকটোজ এনজাইম দিয়ে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে
বিদেশে অনেক ওষুধের দোকানেই সিরাপ, বড়ি বা ক্যাপসুল আকারে ল্যাকটোজ এনজাইম সরবরাহ করা হয়, শিশুর এ ধরনের অসুবিধায় ব্যবহার করার জন্য। ল্যাকটোজ সিরাপ ব্যবহারের নিয়ম হলো এটি শিশুকে খাওয়ানোর ২৪ ঘণ্টা আগে তা দুধে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে করে দুধের শতকরা ৭০ ভাগ ল্যাকটোজ ভেঙে যাবে। এতে শিশুর পক্ষে আর সেই দুধ হজম করতে অসুবিধা হয় না। আবার শিশুকে আইসক্রিম বা পনির খাওয়ানোর আগে একটি ল্যাকটোজ বড়ি খাইয়ে দিলেও শিশুর হজম অনেকটা ভালো হবে। ল্যাকটোজ ক্যাপসুলের ক্ষেত্রে এটি প্রথমে খুলে নিয়ে এর ভেতরের উপাদান চিপে দুধমিশ্রিত বিভিন্ন সেরিয়ালে দিয়ে শিশুকে খাওয়ানো যেতে পারে। এখন শিশুকে কী পরিমাণ ল্যাকটোজ খাওয়াতে হবে, তা শিশুর ল্যাকটোজ অসহনীয়তার ওপর নির্ভর করে এবং এটি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে।
শিশুর পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণের দিকে লক্ষ রাখতে হবে
শিশুর ল্যাকটোজ অসহনীয়তা যদি খুব প্রকট হয়,তখন শিশু দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে যায়। তাই দেখা যায়, সে তার দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যালসিয়াম পাচ্ছে না। তবে শিশুর অস্থি বৃদ্ধিতে এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তাই শিশুকে প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি, ফুলকপি, দই, পনির ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। এভাবে শিশু তার ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। শিশু যদি এগুলোও খেতে না চায়, তাহলে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শমতো সঠিক মাত্রার ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। এ ছাড়া শিশুকে ক্যালসিয়াম-সংবলিত ফলের রসও খাওয়ানো যেতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
বড়দের ক্ষেত্রে ল্যাকটোজ অসহনীয়তা একবার দেখা দিলে তা সারা জীবনের জন্যই রয়ে যায়। তবে শিশুদের বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা সাময়িক অসুবিধা হিসেবে দেখা দেয়। এটি সাধারণত শিশুর ক্ষুদ্রান্ত্রে ভাইরাসের আক্রমণ অথবা খাদ্যে অ্যালার্জিজনিত কারণে হয়। এ ধরনের অসুবিধা কয়েক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে ভাইরাসের আক্রমণকাল বা অ্যালার্জির মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অসুবিধাও দূর হয়ে যায়।
এ ছাড়া অপ্রাপ্ত নবজাত বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রেও কিছু সময়ের জন্য ল্যাকটোজ অসহনীয়তা দেখা দেয়, যত দিন না তাদের ল্যাকটোজ এনজাইম পূর্ণকালপ্রাপ্ত হয়। তাই ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে ল্যাকটোজ অসহনীয়তা দেখা দিলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে তার তত্ত্বাবধানেই রাখতে হবে, যেন তিনি বুঝতে পারেন শিশুর এই অসুবিধা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়েছে কি না। যদি এটি ক্ষুদ্রান্ত্রের কোনো অসুবিধার কারণে ঘটে, তাহলে ডাক্তারই প্রয়োজনমতো তার চিকিৎসা দেবেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ।
cl-ntv