গর্ভাবস্থায় ট্রাইমিস্টার অনুযায়ী খাদ্য তালিকা
গর্ভাবস্থায় খাদ্য তালিকা এমন হওয়া উচিত যেন তা নিম্নোক্ত চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে।
ক) মায়ের ভালো স্বাস্থ্য রক্ষা
খ) বাচ্চার সঠিক বেড়ে ওঠা
গ) প্রসবের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি যোগানো
ঘ) এবং প্রসব পরবর্তীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বুকের দুধ সরবরাহ করা
গর্ভাবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরি দরকার পড়ে, কেননা, এ সময়ে মায়ের কোষ, ফিটাস, প্লাসেন্টা বা অমরা গঠিত হয়। তাই এ সময়ে সাধারণ খাবারের পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত খাবার খেতে হয়। যে সকল মায়ের ওজন সঠিক থাকে, তাদেরকে গর্ভবতী হবার পরে ১১ কেজি ওজন বাড়াতে বলা হয়ে থাকে আর যারা বেশি ওজনের অধিকারী বা BMI ২৬-২৯ তাদের ৭ কেজি ওজন বাড়াতে হয়।
যত মোটা বা ওজন বেশি হবে তত কম ওজন বাড়াতে বলা হয়। মায়ের অতিরিক্ত ওজন হলে অনেকরকম সমস্যা হয়ে থাকে বাচ্চার আর যাদের ওজন কম থাকে আদেরকে ওজন বাড়াতে বলা হয়ে থাকে। কেননা, এতে করে বাচ্চা কম ওজনের হয় ও পুষ্টিহীনতায় ভুগে। আজকে আলোচনা করব গর্ভাবস্থায় খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত বা খাদ্য তালিকায় কী কী না থাকলে খুব সমস্যা হবে সে সম্পর্কে ট্রাইমিস্টার ভাগ করে।
ট্রাইমিস্টার কি?
গর্ভাবস্থা সাধারণত ৯ মাসের কিছু বেশি দিন থাকে। এই ৯ মাসকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম ৩ মাস কে ফার্স্ট ট্রাইমিস্টার, দ্বিতীয় ৩ মাসকে অর্থাত্ ৪-৬ মাস কে সেকেন্ড ট্রাইমিস্টার এবং ৬ মাসের পর থেকে বাচ্চা জন্মের আগ পর্যন্ত সময়কে থার্ড ট্রাইমিস্টার বলে। ট্রাইমিস্টারের গুরুত্ব অনেক। একেক ট্রাইমিস্টারে শিশুর গ্রোথ বা গঠন একেক রকম। তাই ট্রাইমিস্টার অনুযায়ী খাদ্য নির্বাচন করা উচিত।
প্রথম ট্রাইমিস্টার বা গর্ভধারণের পর প্রথম ৩ মাস
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে অনেক মহিলা অনেক চিন্তিত থাকেন তাদের শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে। বিশেষ করে যারা প্রথম মা হতে যাচ্ছেন তারা ভাবেন এ সময়ে অতিরিক্ত খাবার খেতে হবে। ফলে প্রচুর খাবার খেয়ে ওজন অতিরিক্ত বাড়িয়ে ফেলেন। পরে এজন্য অনেক ক্ষতি হয় মা এবং বাচ্চা দুজনেরই। এ সময়ে আপনার দৈনন্দিন সাধারণ খাবারের সাথে অতিরিক্ত ১ গ্লাস দুধ ও ২ টি অতিরিক্ত রুটি খেতে পারেন। এছাড়া তাজা ফলমূল ও শাক সবজি খাবেন। ধূমপান এ সময়ে একদমই করবেন না। কারণ, এতে করে কম ওজনের বাচ্চা জন্মানোর ও বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এসময় প্রচুর পানি খাবেন। ৮ থেকে ১০ গ্লাস। ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাদ্য কম খাবেন। কেননা এতে ঘুম কম হবার ও পানিশূন্যতা হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই পানীয় খেতে চাইলে প্রচুর ফলের জুস, দই, লাচ্ছি খান এবং অবশ্যই এসব বাড়িতে তৈরি করে খাবেন। বাইরের খাবার যত পারবেন তত কম খাবেন। প্রথম ট্রাইমিস্টারে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রয়োজন হয় না যদি আপনার ওজন সঠিক থাকে।
এ সময় কিছু জিনিস অবশ্যই দরকার হয় তার মাঝে একটি হল, ফোলেট বা ফলিক এসিড। ফোলেট কিছু প্রাকৃতিক খাবারে পাওয়া যায়। যেমন -করল্লা, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, মেথি, পুদিনা, ধনিয়া, বাদাম ও কিসমিস। কিন্তু শুধু মাত্র খাবার খেয়ে এর চাহিদা পূরণ হয়না। তাই সাপ্লিমেন্টারি ফুড বা ওষুধ হিসেবে ফলিক এসিড খেতে হয় ডাক্তারের পরামর্শ মতে। সাধারণত ডাক্তাররা ফলিক এসিড ৪০০ মাইক্রোগ্রাম খেতে দেন দৈনিক।ফলিক এসিডের অভাব হলে বাচ্চার spina bifida হয় অথবা neural tube এ সমস্যা হয়। কারণ এ সময়ে বাচ্চার মাথা ও মেরুদন্ডের গঠন শুরু হয় এবং এই গঠনের জন্য ফলিক এসিড খুব দরকার। তাই অবশ্যই ফলিক এসিড খাবেন ডাক্তারের সাথে কথা বলে।
দ্বিতীয় ট্রাইমিস্টার বা ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ মাস
অতিরিক্ত ২০০-৩০০ ক্যালরি খাবার বেশি খাওয়া প্রয়োজন এ সময়ে। সাধারণত একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে বা মহিলার দৈনিক ২২০০ ক্যালরি খাদ্য প্রয়োজন হয়। তাই আপনি গর্ভবতী হলে দৈনিক ২৫০০ ক্যালরি খাওয়া প্রয়োজন। এ সময়ে ভিটামিন ডি ও ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড খেতে হয় প্রচুর। কারণ এ সময়ে ব্রেন বা মস্তিষ্কের ও চোখের গঠন হয় আর এই গঠন সঠিকভাবে হওয়ার জন্য এই পুষ্টিগুলো খুব দরকার। ভিটামিন ডি পাবেন সূর্যের আলোতে, দুধে, দইয়ে, বাদামি চালে ও গমে। ওমেগা ৩ এর জন্য সামুদ্রিক মাছ ও খাবার খেতে হবে। তিসির তেলে ওমেগা ৩ থাকে। সালাদে ২ চামচ তিসির তেল মিশিয়ে সালাদ খাবেন। প্রচুর মাছ খাবেন। এ সময়ে আয়োডিন খাবেন পর্যাপ্ত পরিমাণে।
কেননা, এ সময়ে বাচ্চার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করা শুরু করে আর থাইরয়েডের জন্য আয়োডিন অতীব প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। শুধু আয়োডিনযুক্ত লবণ খেলেই হবেনা, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ আকারেও আয়োডিন খাওয়া যেতে পারে। এ সময় ক্যালসিয়াম খান প্রচুর পরিমাণে। কারণ এটি বাচ্চার হাড়, মাংস ইত্যাদি তৈরিতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় দুধ, দই, আইসক্রিম, চীজ ইত্যাদিতে। সাধারণত এ সময়ে আয়রণ ৪০ মিলিগ্রাম লাগে দৈনিক। এজন্য আয়রণ ট্যাবলেট খাবেন ডাক্তারের পরামর্শমত। এ সময়ে কিছু মিনারেল ও ভিটামিন বেশ কিছু পরিমাণে খেতে হয়।নীচে সেগুলোর নাম ও পরিমাণ দেয়া হলো।
ক্যালরি – ২৫০০ কিলোক্যালরি, পাওয়া যায় প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট থেকে
প্রোটিন – ৬০ মিলিগ্রাম, মাছ, মাংস, ডিম, দুধে থাকে
আয়রণ – ৪০ মি.গ্রা, মাছ, ডিম, কচুতে থাকে
ক্যালসিয়াম – ১০০০ মি.গ্রা, দুগ্ধজাত খাদ্যে থাকে
জিংক – ১৫ মি.গ্রা, মাছ, ডিম ও সামুদ্রিক খাবারে থাকে
আয়োডিন – ১৭৫ মাইক্রোগ্রাম, আয়োডিনযুক্ত লবণ ও সামুদ্রিক খাদ্যে থাকে
ভিটামিন এ – ৬০০০ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট, শাক সবজি, কলিজা ও হলুদ ফলে থাকে
ভিটামিন ডি – ৪০০ আই.ইউ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যে থাকে
থায়ামিন – ১.৫ মি.গ্রা, ঢেঁকিছাটা চালে থাকে
রিবোফ্লাবিন – ১.৬ মি.গ্রা, মাংস, কলিজা থাকে
নিকোটিনিক এসিড – ১৭ মি.গ্রা, মাংস, বাদাম ও শস্য দানাতে থাকে
এসকরবিক এসিড – ৭০ মি.গ্রা, টক জাতীয় ফলমূলে ও টমটোতে থাকে
ফলিক এসিড – ৪০০ মাইক্রোগ্রাম, সবুজ শাকসবজি ও কলিজাতে থাকে
ভিটামিন বি১২ – ২.২মাইক্রোগ্রাম, প্রাণীজ প্রোটিনে থাকে
তৃতীয় ট্রাইমিস্টার বা ৭ম মাস থেকে ৯ মাস বা বাচ্চা জন্মানোর আগ পর্যন্ত
এ সময়ে উপোরক্ত তালিকা মতই খাদ্য চালিয়ে যান। পানি খান প্রচুর। এ সময়টাতে বেশি কোষ্ঠকাঠিন্য হবার সম্ভাবনা থাকে। আদা চা অনেক মহিলাদের এই কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয়। তবে এ সময় আঁশযুক্ত ফল ও শাকসবজি খাওয়া উচিত। এসব খাবারে অনেক আঁশ রয়েছে যা পায়খানা নরম করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। খুব ঝাল ও ভাজা পোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন। এসব খাবার খেলে এসিডিটি হয়।