শিশুর শিক্ষা অর্জনে মায়ের ভুমিকা

মানুষের প্রাথমিক জীবনে অর্জিত শিক্ষা কঠিনভাবে হৃদয়ে গ্রথিত হয় এবং তা বাস্তব জীবনকে প্রভাবিত করে। আরো এগিয়ে গিয়ে বলতে হয় প্রাক প্রাথমিক শিা তথা মায়ের কাছ থেকে জীবনের সূচনায় অর্জিত শিক্ষা আবশ্যকীয়ভাবে ভবিষ্যৎ জীবনে পথ নির্দেশ করে। এ জন্য তুর্কি কবি আবদুর রহমান আল কাশগরি একটি কবিতার শিরোনাম দিয়েছেন ‘হিজনুল উম্মাহাত হিয়া আল মাদরাসাতু লিল বানিনা ওয়াল বানাত’ অর্থাৎ ‘মায়ের কোল বালক-বালিকাদের জন্য পাঠশালা স্বরূপ’। সেখানেই মানুষের উত্তম অনুত্তম গুণাবলির সব শিক্ষা অর্জিত হয়। একজন সন্তানকে সৎ চবিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে তার সূচনা করতে হবে মাতৃকোল থেকেই। কাশগরি তার কবিতায় লিখেছেন, ‘লাম আরা লিল খালাইকি মিন মাহাল্লিন/ইউহাযযিবুহা কাহিযনিল উম্মাহাতি’। অর্থাৎ আমি মাতৃকোলের মতো এমন উত্তম স্থান আর দেখিনি, যা তাকে সচ্চরিত্রবান করে তোলে। তিনি আরো বলেছেন ‘ফা হিজনুল উম্মি মাদরাসাতুন তাছামাত/বিতারবিয়াতিল বানিনা ওয়াল বানাত’ অর্থাৎ মাতৃকোলই শিশুর উত্তম বিদ্যালয়; যে বিদ্যালয় সন্তানের চরিত্র গঠনের কাজে নিয়োজিত। এ বিদ্যালয় থেকেই সন্তানরা উত্তম চরিত্র ও মহৎ গুণাবলির শিক্ষা গ্রহণ করে।
নেপোলিয়ন বলেছেন,  অর্থাৎ ‘আমাকে একটি ভালো মা দাও আমি তোমাকে একটি ভালো জাতি উপহার দেবো।’ নেপোলিয়নের দর্শন হলো মানুষের নৈতিক গুণাবলি অর্জিত হয় শৈশবকাল থেকে আর শৈশবের শিক্ষা অর্জিত হয় মায়ের কোলেই। শিশুর চিরন্তন স্বভাব গঠনে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। মায়ের কাছে শিশু শেখে উদারতা, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, সত্যবাদিতা। মা-ই শিশুকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাতে পারেন। শিশুর আত্মবিশ্বাস অর্জিত হয় মায়ের কাছ থেকেই।
মা শিশুকে কোলে তোলে বড় বড় মনীষীর গল্প শোনায়। তাদের গল্প শোনালে তার মাঝে বড় হওয়ার স্বপ্ন জাগে। রাসূল স:-এর সত্যবাদিতার কাহিনী শোনালে তার মাঝে সত্যবাদিতার গুণ অর্জিত হয়। আবদুল কাদির জিলানি র:-এর চিরন্তন সত্যবাদিতার কাহিনী সন্তানের হৃদয়পটে সত্যবাদিতার প্রেরণা জোগাবে। এমনিভাবে শিশুর মহৎ গুণাবলি অর্জনে মা-ই একমাত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তা গল্প ছলে হোক কিংবা উপদেশ ছলে হোক। অন্য দিকে অসৎ গুণাবলির প্রতি ঘৃণা জন্মানোর ক্ষেত্রেও মায়ের ভূমিকা অগ্রগণ্য। অন্যের গৃহ থেকে না বলে কোনো জিনিস নিয়ে আসার পর মায়ের প্রশ্র্রয় দান সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনে চৌর্যবৃত্তি কিংবা বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতে পারে। এ জন্য ইমারসন সংক্ষেপে বলে দিয়েছেন, ‘মানুষের মা তাদের যা বানিয়েছেন মানুষ তা-ই’। হাওয়ার্ডের কথায় বিষয়টি আরো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, ‘আমি তেমনই মানুষ যেমন আমার মা আমাকে তৈরি করেছেন।’

প্রত্যেক শিশু প্রথম শিক্ষা পায় মায়ের কাছে। আর প্রথম শিক্ষা শিশুরা বিনা বিচারে গ্রহণ করে। তাদেরকে তখন যা শেখানো হয় তা-ই তারা সত্য বলে গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী তাদের মন মানসিকতা তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে কোনো সত্য বিষয়ও তার কাছে উপস্থাপন করা হলে সে প্রথমটিকে ভিত্তি করে বিচার করে। সুতরাং প্রত্যেক মায়ের ভেবে দেখা উচিত তাদের কোমলমতি সন্তানদের হৃদয় কাননের উর্বর ভূমিতে কেমন গুণাবলির চারা রোপণ করতে হবে।
হজরত ওমর রা:-এর দরবারে একজন লোক তার সন্তানকে নিয়ে এসে বললেন, এ আমার সন্তান, সে আমার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তখন হজরত ওমর (রা:) ওই ছেলেটাকে বললেন, তুমি কি আল্লাহকে ভয় করো না? পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা বড়ই গোনাহের কাজ তা কি তুমি জানো না? সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার যে অনেক হক রয়েছে তা তুমি কিভাবে অস্বীকার করতে পার? ছেলেটি বলল, হে আমিরুল মোমেনিন, পিতা-মাতার ওপরও কি সন্তানের কোনো হক আছে? হজরত ওমর রা: বললেন, নিশ্চয়! এবং তা হলো, প্রথমত: পিতা নিজে সৎ ও ভদ্র মেয়ে বিয়ে করবে, যেন তার সন্তানের মা এমন কোনো নারী না হয় যার দরুন সন্তানের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হতে পারে বা লজ্জা অপমানের কারণ হতে পারে। দ্বিতীয়ত: সন্তানের ভালো কোনো নাম রাখবে এবং তৃতীয়ত: সন্তানকে আল্লাহর কিতাব এবং দ্বীন ইসলাম শিক্ষা দেবে। তখন ছেলেটি বলল, আল্লাহর শপথ আমার এ পিতা-মাতা আমার এ হকগুলোর কোনোটিই আদায় করেনি। তখন হজরত ওমর রা: লোকটিকে ল্য করে বললেন, ‘তুমি বলেছ তোমার সন্তান তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আসলে তো তার আগে তুমিই তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। চলে যাও এখান থেকে। হাদিসটিতে প্রমাণিত হয় সন্তান গড়ার দায়িত্ব শুরু হয় পিতার বিয়ের আগে। প্লেটো বলেছেন, ‘মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যৎ বুনিয়াদ’।
সুতরাং সন্তানের দুনিয়া ও আখিরাত সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে মাকেই জীবনের প্রথম থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের মাঝে পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় জাগ্রত করা, বাস্তব জীবনোপযোগী শিক্ষায় শিতি করে তোলা মাতা-পিতারই দায়িত্ব। হজরত রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, ‘পিতা-মাতা সন্তানকে সুষ্ঠুশিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম আর কিছুই দিতে পারে না’।
সন্তানকে সত্যিকার মানুষ করে গড়ে তুলতে হলে ধর্মীয় শিার বিকল্প নেই। আবার সন্তানদের মাঝে দুর্বৃত্তায়ন দানা বাঁধে তার ধর্মীয় শিার অভাবেই। ধর্ম মানুষকে সঠিক পথের দিশা দান করে। আপনি আপনার সন্তানকে পড়ালেখা এবং গণিত শিক্ষঅ দিলেন অথচ তাকে ধর্ম শিক্ষা দিলেন না তাহলে আপনি আপনার সন্তানকে দুর্বৃত্ত বানালেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।’ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে জারির তাবারি র:-এর বক্তব্য দিয়েই উপসংহার টানছি, আল্লাহর এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সন্তানদের দ্বীন ইসলাম ও সব কল্যাণময় জ্ঞান এবং অপরিহার্য ভালো চরিত্র শিক্ষা দান করা আমাদের কর্তব্য।

Sharing is caring!

Comments are closed.