শিশুর হেঁচকি : করণীয়
হিক্কা বা হেঁচকি কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা না হলেও এটি যথেষ্ট বিরক্তিকর। কীভাবে হিক্কা হয়? যেকোনো কারণেই হোক একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ডায়াফ্রাম বা মধ্যচ্ছদার ( যে মাংসপেশি উদর গহ্বরে বক্ষ গহ্বর থেকে পৃথক করে রাখে) সংকোচন ঘটে এবং স্বররজ্জু ( ভোকাল কর্ড) হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ‘হি্ক’ শব্দের সৃষ্টি হয়। এভাবে হিক্কা হয়।
এটি সাধারণত বদহজম। খুব তাড়াতাড়ি কিছু খেলে বা পান করল, খালি পেটে হাসলে এবং ক্লান্ত হয়ে গেলে ইত্যাদি কারণে এটি হতে পারে। এ ছাড়া আরো অনেক কারণ রয়েছে। তবে হিক্কার সঠিক কারণ সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
এর প্রশমনের উপায় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকভাবে রয়েছে মত পার্থক্য। একেকজন একেক পদ্ধতির কথা বলেন। তবে এর মধ্যে অনেক কাজেও আসে। সেই রকম কিছু পদ্ধতির কথা এখানে উল্লেখ করা হলো-
ছোট্ট শিশুর জন্য
শিশুর পিঠ চাপড়ে দিন
শিশুর হিক্কা শুরু হলে তাকে কাঁধের ওপর খাড়া করে নিয়ে পিঠে আস্তে আস্তে চাপড়ে দিতে হবে। শিশুরা দুধ খাওয়ার সময় বিশেষ করে বোতলে দুধ খাওয়ার সময় অনেক সময় প্রচুর বাতাস গিলে ফেলে। এতে তাদের পাকস্থলী বাতাসে ফুলে ওঠে, হিক্কা শুরু হয়। এ সময় শিশুকে খাড়া করে ধীরে ধীরে পিঠ চাপড়ালে বাতাস উপরে উঠে আসে এবং হিক্কা থেমে যায়।
ফিডারের নিপল ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে
ফিডারের নিপলের ছিদ্র যদি বেশি বড় বা ছোট হয়, তাহলে শিশু বেশি বাতাস গিলে ফেলে হেঁচকির শিকার হয়। নিপলের ছিদ্র এমন হওয়া উচিত যেন বোতল উপুর করে ধরলে ফোঁটা ফোঁটা করে দুধ পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যদি তার বদলে বোতল থেকে এক নাগাড়ে দুধ পড়তে থাকে অথবা একেবারেই না পড়ে তাহলেই সমস্যা। এজন্য বোতল ও নিপল বদলে দেখা যেতে পারে কোনটি শিশুর জন্য প্রযোজ্য।
দেরি না করে ঠিক সময়মতো শিশুকে খাওয়ান
শিশুর খাওয়ানোর সময় হিক্কা উঠলে খাওয়ানো বন্ধ করা ঠিক নয়। হিক্কা শিশুর খাওয়াতে কোনো অসুবিধাই সৃষ্টি করে না। উপরন্তু খেয়ে পেট ভরলে হিক্কা বরং বন্ধ হয়ে যায়।
শিশুকে একসঙ্গে অতিরিক্ত খাওয়ানো ঠিক নয়
শিশুর জন্মের প্রথম কয়েক মাস যদি দেখা যায়, প্রতিবার খাওয়ানোর পরপরই হিক্কা ওঠে, তাহলে বোঝা যাবে অতিরিক্ত খাওয়ানোই শিশুর হিক্কার কারণ। তাই এ অবস্থায় শিশুকে একেবারে বেশি না খাইয়ে অল্প অল্প করে বার বার খাওয়ানো ভালো। আর যদি মায়ের সন্দেহ হয় যে সত্যিই তিনি শিশুকে বেশি বেশি খাইয়ে ফেলেছেন, তাহলে শিশুকে নিজের তৈরি রুটিনমতো না খাইয়ে শিশু যখন খাবারের জন্য কান্না করবে কেবল তখনই শিশুকে খেতে দেওয়া উচিত। শিশু যখন আর খেতে চাইবে না, তখন জোর না করে খাওয়ানো বন্ধ করে দিতে হবে।
একটু বড় শিশুর জন্য
একনাগাড়ে পানি পান করে হিক্কা বন্ধ করা যেতে পারে
শিশুর হিক্কা শুরু হলে সে যদি অনেক্ষণ ধরে পানি পান করে, ২-৩টা হিক্কা বাদ ফেলতে পারে, তাহলে হিক্কা একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এভাবে হিক্কা বন্ধ করার জন্য শিশুকে কমপক্ষে এক নিঃশ্বাসে ১০ চুমুক পানি পান করতে হবে।
চামচে করে চিনি দিয়ে দেখা যেতে পারে
শিশুর বয়স যদি দুই বছরের বেশি হয় তাহলে হিক্কা উঠলে তাকে চামচে করে কিছু চিনি বা মধু দিয়ে দেখা যেতে পারে। এতে অবশ্য সবসময় হিক্কা বন্ধ হয় না। তবে শিশু ব্যাপরটি বেশ উপভোগ করে।
দম বন্ধ করে রাখার প্রতিযোগিতা করা যেতে পারে
হিক্কা উঠলে শিশুর সঙ্গে খেলার ছলে দম বন্ধ করে রাখার প্রতিযোগিতা করতে হবে। শিশুকে বলতে হবে ‘দেখি কে কত সেকেন্ড দম বন্ধ রাখতে পারে’। এভাবে শিশু যদি বেশ কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে রাখতে পারে তাহলে ফুসফুসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং শিশু হিক্কা থেকে রক্ষা পাবে।
হঠাৎ করে শিশুর মনোযোগ পরিবর্তন করে দেখা যেতে পারে
এটি একটি প্রচলিত নিয়ম। শিশুর হিক্কা উঠলে হঠাৎ করে যদি তার মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ভালো হয়। যেমন যদি হঠাৎ চিৎকার করে বলা যায়- সাপ, সাপ! অথবা শিশুর কোনো প্রিয় খেলনার কথা উল্লেখ করে বলা যেতে পারে-‘ইশ ওটাতো ভেঙ্গে গেছে’। এভাবে শিশুকে ভীত বা অবাক করে দিতে পারলে অনেক সময় হিক্কা বন্ধ হয়ে যায়।
অনেক সময় পেটের মধ্যে থাকা অবস্থায়ও শিশুর হিক্কা উঠতে পারে এবং কেবল মাই তা টের পায়। এ সময় হিক্কা ২০ মিনিট বা তারও বেশিক্ষণ ধরে চলতে পারে। তারপর একা একাই ঠিক হয়ে যায়। এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও বিপদমুক্ত। এতে মায়ের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন
হিক্কা সাধারণত ৫-১০ মিনিটের বেশি থাকে না। তবে কোনো কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যক্রমে হিক্কা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রে কোনো রোগের লক্ষণ হিসেবে হিক্কা দেখা দিতে পারে। তাই যদি কখনো দেখা যায় যে শিশুর হিক্কা একদিনের বেশি সময় ধরে চলছে তাহলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হলিফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ