ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুকে কখন হাসপাতালে নেবেন?
প্রশ্ন : এই সময় ডায়রিয়া বেশি কেন হচ্ছে এবং ডায়রিয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় কী?
উত্তর : এখন বন্যা হচ্ছে, পানি জমে যাচ্ছে। এই জিনিসগুলোর জন্য ভালো পানির অভাব হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব হচ্ছে। অনেক জায়গায় পানির যে পদ্ধতি সে কারণেও এর ভেতরে অনেক রোগ-জীবাণু চলে আসছে। যে কারণে আমাদের ডায়রিয়া বেশি হচ্ছে। এবং শিশুরাই এর বেশি শিকার হচ্ছে। কারণ শিশুদের ক্ষেত্রে আমরা বেশি পানি ব্যবহার করার চেষ্টা করি। তাদের পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। এখন আসলে সব ধরনের ডায়রিয়া হচ্ছে। ভাইরাল ডায়রিয়া হচ্ছে, আবার ইনভেসিভ ডায়রিয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের সম্পূর্ণ আবহাওয়াগত অবস্থা সেটি অনেকটা দায়ী ডায়রিয়ার জন্য। আর পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ও একটি সমস্যা, সেটাও দায়ী এর জন্য।
প্রশ্ন : তাহলে শিশুদের বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা দেওয়ার উপায় কী? কারণ বিশুদ্ধ পানি না হলে ডায়রিয়ার যে জীবাণু সেটা পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে। এতে শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে…
উত্তর : আমাদের জন্য বিষয়টি কঠিন। কারণ কিছু কিছু জায়গা আছে খুব ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। বিশেষ করে আমি যেখানে প্র্যাকটিস করি সেটা পুরান ঢাকা। পানির লাইন একটা বাড়ির সঙ্গে আরেকটি বাড়ি লাগানো। বা অনেক জায়গায় বস্তি। সেখানে পানির খুব ভালো সাপ্লাই নেই।
প্রথমত, অবশ্যই চিন্তা করতে হবে পানি ফুটানোর। পানি ফুটানো ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। সবাই তো আর দামি দামি ফিল্টার ব্যবহার করতে পারবে না। এই কারণে আমাদের মনে হয় ফোটানোটাই ভালো। এ জন্য কিছুটা পানি জমিয়ে রেখে, তলানি করে এরপর যদি ফোটানো যায়, অথবা ফোটানোর পর যদি জমিয়ে রাখা যায় তাহলে ভালো হয়। আর দেখতে হবে যে পানিটি সন্দেহজনক সেই পানিগুলো যেন আমরা খাবারের জন্য ব্যবহার না করি। আর যদিও এতেও দুশ্চিন্তা থাকে তাহলে বোতলজাত পানি পান করা যেতে পারে। অবশ্য এখনো বোতলজাত পানি নিয়েও অনেকে সন্দেহে থাকে। এ ছাড়া ফিল্টার রয়েছে সেগুলোও আমরা ব্যবহার করতে পারি।
প্রশ্ন : খাওয়ার বেলায় তো বিশুদ্ধ পানি খেতেই হবে। তবে শিশুদের গোসল করানো বা ধোয়া-মোছার বিষয়ও কি বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে, না কি ট্যাপের পানি?
উত্তর : আমি সাধারণ ট্যাপের পানির পরামর্শ একেবারেই দেব না। কারণ শিশুরা গোসল করার সময় নাকে মুখে অনেক পানি চলে যায়। কিংবা খেয়ে ফেলে অনেক পানি।
সাধারণ ট্যাপের পানি অবশ্যই শিশুদের জন্য ভালো হবে না। তাই এটা ফুটিয়ে নিতে হবে, সেটা যত পরিশ্রমই হোক, যত কষ্টই হোক।
প্রশ্ন : একটা শিশুর যদি ডায়রিয়া হয়, সে ক্ষেত্রে ছোট বাচ্চাদের বেলায় মায়েরা খুব আতঙ্ক বোধ করেন। আপনি বলবেন কি কোন লক্ষণ দেখা দেওয়া পর্যন্ত তাকে বাসায় ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। সেটি কীভাবে? এবং কী ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে তাকে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে?
উত্তর : এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এটা জানা দরকার। তিনবারের বেশি পাতলা পায়খানা হলে একে আমরা ডায়রিয়া বলি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যদি তিনবার হয়। এ ছাড়া সারা দিনের মধ্যেও যদি তিন বা এর বেশিবার খুব পাতলা পায়খানা হয় একে আমরা ডায়রিয়া বলি। তবে যদি অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা না হয়, তবে শরীরের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা তখনই আশঙ্কা করব যে ডায়রিয়া হচ্ছে অনেকবার, শরীর থেকে অনেক পরিমাণে পানি চলে যাচ্ছে এবং শরীরে পানিশূন্যতা হচ্ছে, তাহলে সমস্যা রয়েছে।
প্রশ্ন : সেটা বোঝার উপায় কী?
উত্তর : চোখ গর্তে চলে যাবে। পেটের চামড়া ঢিলা হয়ে যাবে। আর খুব বেশি হলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মুখ-চোখ শুষ্ক হয়ে যাবে। বাচ্চাটা খেতে পারবে না। শক্তিহীন হয়ে পড়বে। শরীর থেকে যখন পানি চলে যায় তখন শরীরে পটাশিয়াম, সোডিয়ামের ভারসাম্যহীনতা হয়। এতে বাচ্চাটা দুর্বল হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। তখন বাচ্চাটা কোনো কিছু খেতেও পারে না। সেই রকম কিছু দেখলে আমরা বাচ্চাটিকে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যাব। আর সারা দিনে যদি তিনবার বেশি পাতলা পায়খানা হয়, তবেও সতর্ক হতে হবে। প্রস্রাব যদি কমে যায় তবে দ্রুত বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিতে হবে।
প্রশ্ন : হাসপাতালে নিলে আপনার ওরস্যালাইনের বাইরে কী ব্যবস্থাপনা করেন?
উত্তর : আইসিডিডিআরবি বা কলেরা হাসপাতালের মুখে স্যালাইন খাওয়ার বিষয়টি বেশি করা হয়। তবে আমাদের কাছে খুব খারাপ অবস্থায় বাচ্চারা যায়। তখন তাদের স্যালাইন দিতে হয়। তখন আর মুখে খাওয়ার স্যালাইন না দিয়ে আইভি স্যালাইন দেওয়া হয়। যে পর্যায়ে আমাদের এখানে বাচ্চাগুলো আসে তারা খুব খারাপ পর্যায়ে আসে। এরপর ইলেকট্রোলাইট যদি ভারসাম্যহীন হয়, সেগুলোকে ভারসাম্য দেওয়ার চেষ্টা করি। সাধারণত ভাইরাসজনিত ডায়রিয়াই বেশি হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। তবে কোনো ক্ষেত্রে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করি। ডায়রিয়ার পাশাপাশি যদি অনেক বেশি জ্বর হয়, তখন অ্যান্টিবায়োটিক দিই। ধারণা করা হয়, এর বাইরেও কোনো সংক্রমণ রয়েছে। ডায়রিয়াটা হয়তো ব্যাকটেরিয়ার কারণে হতে পারে।
প্রশ্ন : হাসপাতালে নিতে দেরি করলে কী কী অসুবিধা হতে পারে?
উত্তর : দেরি করলে অনেক অসুবিধাই হতে পারে। প্রস্রাব একেবারের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতার কারণে হাইপোক্যালেমিক হতে পারে। পানিশূন্যতা থেকে শক হয়ে যেতে পারে। সেই বাচ্চাটা মারাও যেতে পারে। ডায়রিয়ার যদি সময়মতো চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে বাচ্চার জীবনের বিরাট ঝুঁকি হতে পারে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের এপিডেমিউলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রিয়াজ মোবারক।
cl-ntv