কীভাবে কথা বলবেন সন্তানের সঙ্গে?

‘মিতুল, প্রতিদিন সকালে তুমি অসম্ভব বিরক্ত করো আমাকে। সব কাজে এত লেট করো, স্কুল থেকেও তোমার ব্যাপারে ভালো রিপোর্ট পাচ্ছি না। এ রকম চলতে থাকলে তোমার বাবাকে বলব ব্যবস্থা নিতে। আমি আর পারছি না।’ চিৎকার-চেঁচামেচি করে বলা এই কথাগুলো নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে মিতুলের জীবনে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসছে না বলে মা-বাবা আরও হতাশ হয়ে পড়ছেন এবং মিতুলেরও সবকিছুর প্রতি আগ্রহ দিন দিন কমছে।

আসুন, আমরা একটু ভেবে দেখি পরিবারে, অফিসে কিংবা বন্ধুদের মাঝে কী ধরনের কথা প্রতিনিয়ত আমাদের শুনতে হয়। নেতিবাচক কথা শুনলে আমাদের কেমন লাগে এবং প্রশংসা আমাদের মধ্যে কেমন অনুভূতি তৈরি করে।

মা-বাবা হিসেবে সন্তানের মঙ্গল আমরা সব সময় কামনা করি। ওদের ভালো চাই। বর্তমান প্রতিযোগিতার যুগে মা-বাবা সারাক্ষণ ছেলেমেয়েকে নিয়ে তটস্থ থাকেন, কীভাবে তাদের আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। অভিভাবকেরা যখন দেখেন পাশের বাসায় তাঁদের সন্তানের সমবয়সী কেউ অথবা কোনো আত্মীয়র ছেলেমেয়ে খুব ভালো ফলাফল করছে তখন মা-বাবা একধরনের তাড়না অনুভব করেন। যার ফলাফল অনেক সময় দাঁড়ায় নেতিবাচক ভাষার প্রয়োগে।

‘তোকে দিয়ে কিছুই হবে না। ওদের দেখে শিখতে পারিস না?’ এ কথাগুলো আমরা অহরহ তুলনা করার কাজে ব্যবহার করি। অনেক অভিভাবক নিজেদের একাধিক সন্তানের মধ্যে এমন তুলনা এনে একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেন নিজের ঘরেই। দেখা যায় নিজের মনমতো করে গড়তে তাদের এমন চাপ প্রয়োগ করেন মা-বাবা, যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনেও গড়ায়।
আবার অনেক সময় এমন হয় যে সন্তানদের মধ্যে ভালো কিছু দেখলেও আমরা তা এড়িয়ে যাই। আমাদের মধ্যে চিরায়ত একটা ধারণা—প্রশংসাসূচক কথা বললে সন্তান যদি নষ্ট হয়ে যায়! এটা যে সন্তানের মনে কী গভীর ক্ষত তৈরি করে, তা হয়তো একটু ভাবলে নিজেরাই বুঝতে পারব।

সন্তানদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না, যদি নেতিবাচক ভাষার ব্যবহার বন্ধ করা যায়। সারাক্ষণ ‘তোকে দিয়ে কিছুই সম্ভব নয়’ শুনতে শুনতে সন্তানদের অবচেতন মনে একসময় সেটাই গেঁথে যেতে পারে এবং ওরা সেটাই অনুকরণ করতে থাকে। এমনকি একসময় সেটা সত্যিও হয়ে দাঁড়ায়।

আপনি আপনার সন্তানের সঙ্গে যে ভাষা প্রয়োগ করছেন, তা আসলেই ঠিক কি না অথবা তাকে যা বলে সম্বোধন করছেন তাকে সেভাবেই আপনি দেখতে চান কি না। যদি তা না হয়, তবে ভাষার ব্যাপারে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়নে মা-বাবারও নানা রকম দুঃখ, হতাশা ও মানসিক চাপের মধ্যে যায়। তাই হঠাৎ রেগে যাওয়াটা আমাদের মধ্যে আসতেই পারে। সন্তানদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা যদি একটু খেয়াল করি যে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো ওদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি কি না। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলছি তা-ও সন্তানদের মধ্যে প্রভাবিত হয় যা তাদের ভাষাকে এবং একই সঙ্গে মানসিক অবস্থাকেও প্রভাবিত করে।

সন্তানেরা যদি কোনো ভুল করে থাকে চিৎকারেই কি সমস্যার সমাধান হয়? আপনার রাগ ওদের চিন্তা করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আপনার রাগের কথায় যৌক্তিকতা থাকলেও তা তারা বুঝতে পারবে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সে হয়তো আপনার কথা শুনছে তবে অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় সে হয়তো কাজটি আবার করছে, আপনাকে লুকিয়ে।

শান্ত ভাষায় ভালো করে কথা বলার মানে কিন্তু এই নয়, আপনি তাদের ভুল প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ভুল সবাই করে, আমাদেরও ভুল হয়ে থাকে। তাই ধৈর্য ধরুন, তাদের কোথায় ভুল হচ্ছে তা ধরিয়ে দিন, ভুলের পরিণাম কী হতো তা সন্তানকে বুঝতে সাহায্য করুন।
আপনি যা বলছেন তা আপনার সন্তানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার প্রশংসায় ওরা উদ্দীপ্ত ও খুশি হয়। অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করে ওদের নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করুন এবং তাতে বিশ্বাস রাখুন। সবাই এক রকম নয়—এটা মেনে নিয়ে ওরা যা ভালো করতে পারে, তা নিয়েই কথা বলুন। সে ব্যাপারে আগ্রহ দেখান। ওদের সঙ্গে খোলামনে কথা বললে ওরাও আপনার সামনে নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করবে। আপনার এই কথা বলার ধরনই ওদের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। ওদের আত্মমর্যাদাবোধ বাড়াবে এবং জীবনটাকে ইতিবাচকভাবে ভাবতে শেখাবে।

লেখক: প্রভাষক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলর

Sharing is caring!

Comments are closed.