গর্ভাবস্থায় রোজা রাখা – কিছু পরামর্শ

সকল মুসলমানদের জন্য রমজান মাসে রোজা রাখা ফরয। গর্ভাবস্থায়  রাখা নিয়ে গর্ভবতী মহিলারা এসময়টায় বেশ চিন্তিত থাকেন। অনেক গর্ভবতী মহিলা রোজা রাখতে চান, আবার অনেকে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হবে ভেবে রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধায় থাকেন।  তবে প্রকৃতপক্ষে রোজা রাখা যাবে কি যাবে না তা নির্ভর করে গর্ভধারণকারী নারীর উপর। গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য ও গর্ভের সন্তানের স্বাস্থ্যে উপর ভিত্তি করেই একজন গর্ভবতী নারী চাইলে রোজা রাখতে পারেন।

যদি আপনি স্বাস্থ্যবতী হোন এবং গর্ভাবস্থায় আপনি জটিলতা মুক্ত থাকেন, তবে রোজা রাখলে আপনার কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।তারপরেও আপনি রোজা রাখতে পারবেন কি পারবেন না, তা জানতে রোজার পূর্বেই আপনার ডাক্তারের মতামত নিন। একজন পুষ্টিবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলে নিন এবং একটি সুষশ খাদ্য তালিকা অনুসরণ করুন।

গর্ভাবস্থায় রোজা সম্পর্কে গবেষণা এবং ধর্মীয় মতামতঃ

গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় রোজা রাখলে গর্ভস্থ শিশুর গ্রোথ, ডেভেলপমেন্ট এবং জন্মকালীন ওজনের উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য হয় না। গর্ভস্থ বাচ্চা মায়ের পুষ্টি নিয়েই বেড়ে ওঠে। সুতরাং মায়ের কোনো সমস্যা না হলে গর্ভস্থ বাচ্চার সমস্যা হওয়ার কথা না।তবে গর্ভ ধারণ করার প্রথম তিন মাসের মধ্যে রোজা রাখলে সন্তানের ওজন কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটাও খুব একটা উল্লেখযোগ্য হারে নয়। এবং এতে বাচ্চার ওপর কোনো প্রভাবও পড়ে না।

ওজন কম থাকার দরুন ভবিষ্যতে বাচ্চার বুদ্বিমত্তার ঘাটতি থাকতে পারে বলে যে কথা প্রচলিত আছে তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই।মোদ্দা কথা হচ্ছে, লম্বা সময় ধরে রোজা রাখলে শরীরে পানির অভাব দেখা দিলে অথবা শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে রোজা রাখা উচিত নয়। তবে সম্পূর্ন সুস্থ এবং সক্ষম গর্ভবতী মহিলাদের জন্য রোজা রাখা বারণ নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলেমগন গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখা না রাখা বিষয়ে কোরান হাদিসের আলোকে মতামত প্রদান করেছেন। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা যারা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কিত হতে পারেন বা যেখানে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে এমন মায়েদের জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয় বলে বেশিরভাগ আলেমগন মতামত দিয়েছেন। এছাড়া ইসলামে ‘ফিদায়াহ’ নামের একটি শব্দের উল্লেখ আছে যার অর্থ হলো,কোন ব্যক্তি রোজা রাখতে অক্ষম হলে তিনি যতদিন রোজা রাখতে পারবেন না সেইসব দিনের রোজার সময় গরিব-এতিমদের খাওয়ানোর মাধ্যমে তা পূরণ করে নিতে পারেন।

হবু মায়েদের জন্য কিছু পরামর্শঃ

  • রোজার রাখার  ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সর্বপ্রথম একজন গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নেয়া উচিত।
  • এ সময় কারও কারও অতিরিক্ত বমি হতে পারে। খুব বেশি বমি হলে তাঁর রোজা না রাখাই ভালো।এ ছাড়া অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলেও রোজা না রাখাই ভালো।
  • গর্ভধারণের তিন মাসের পর থেকে সাধারণত বমির সমস্যা কমে আসে। এ সময় মা রোজা রাখতে পারেন।তবে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে যদি গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া কমে যায়, তাহলে সেই মায়ের রোজা না রাখাই ভালো।
  • ডায়াবেটিস, অ্যানেমিয়া এবং প্রি-অ্যাকলেমপসিয়া আছে কিনা পরীক্ষা করে নিন। ডায়াবেটিস যদি থেকে থাকে তবে রোজা রাখাকালীন সময়ে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যেতে পারে তখন গর্ভবতী মা ও শিশু মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এছাড়া অ্যানেমিয়া আক্রান্ত মায়েরা শারিরিক দুর্বলতা অনুভব করতে পারেন, তাই অতিমাত্রায় অ্যানেমিয়া আক্রান্ত মায়েদের গর্ভাবস্থায় রোজা না  রাখাই শ্রেয়।
  • রোজা শুরুর পূর্বে একজন পুষ্টিবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ডায়েট প্ল্যান তৈরি করে রাখতে পারলে ঐ সময়ে গর্ভবতী মায়ের শরীরে পুষ্টি মান অটুট থাকে।

রোজা রাখাবস্থায় কিছু বিষয়ের প্রতি যত্নবান হনঃ

  • শরীরের ওজন সবসময় পরীক্ষা করুন।
  • আপনি খুব তৃষ্ণার্ত থাকেন কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
  • প্রচণ্ড মাথা ব্যথা অনুভব করছেন কিনা?
  • বমি ভাব বেড়ে যাচ্ছে কিনা?

গর্ভাবস্থায় রোজা রাখলে যা করবেনঃ 

  • রোজার কারণে দীর্ঘক্ষণ রোজা রাখার ফলে আপনি এবং আপনার গর্ভের শিশু প্রয়োজনীয় খাদ্য ও তরল থেকে বঞ্চিত হবে,তাই ইফতার থেকে সেহেরী পর্যন্ত পানি আর পুষ্টিকর খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। যদি আপনি রোজা রাখেন, তবে ইফতারের সময় অতিরিক্ত খাবার খাবেন না।
  • রোজা রাখার ফলে আপনার পরিপাক ক্ষমতা ধীর হয়ে যায়, তাই ইফতার করতে হবে যথাসম্ভব ধীরে। প্রথমে ছোট এক গ্লাস ফলের রস বা পানি পান করুন। এরপর অল্প খাবার গ্রহণ করুন। এক বা দুই ঘন্টা পরপর বারবার অল্প করে খাবার খান। প্রচুর পরিমাণ তরল এবং পানি পান করুন।
  • দিনের বেলায় কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম গ্রহণ করুন। রোজা রাখার সময় কোন শ্রমসাধ্য কাজ বা ব্যায়াম করা যাবেনা। একটি খাবারের ডায়েরী সাথে রাখা উচিত। তাহলে আপনি কখন কি খাচ্ছেন তা সহজেই জানতে পারবেন।
  • আপনার সেহরীতে জটিল ধরণের শর্করা জাতীয় খাদ্য থাকা উচিত, কারণ এই ধরণের খাবার পরিপাক দীর্ঘ সময় লাগে এবং তা সারা দিন ধরে আপনার শক্তি সরবরাহে সাহায্য করবে।
  • তবে ডুবো তেলে ভাজা খাবার যেমন- বেগুনী (গর্ভাবস্থায় বেগুনী খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত), পিঁয়াজু, আলুর চপ ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। এই তেল ও চর্বিযুক্ত খাবারগুলো আপনার উদরপুর্তি করলেও তা আপনার পুষ্টির চাহিদা পুরণ করবে না। এগুলো বদহজমও তৈরী করতে পারে।
  • খাবার শেষ করার সময় সিরাপ নির্ভর খাবার যেমন- জিলাপী খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এর পরিবর্তে এক বাটি তাজা ফলের সালাদ বা দই বডা খেতে পারেন। চা বা কফি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। এগুলো আপনার প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আপনার দেহ থেকে অতিরিক্ত তরল বের করে দেয়। যদি খালি পানি পান করতে একঘেয়ে লাগে তবে দুধ, দই, বরফ এবং ফলমূল দিয়ে তৈরী সালাদ খেতে পারেন।
  • রাতের খাবারের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন এবং তারপর বাকি কাজ করুন। ঘুমানোর আগে অন্য কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন, তবে অবশ্যই সেহেরী খাবেন। পানিশূন্যতা রোধে ইফতার এবং সেহেরীর মধ্যবর্তী সময়ে প্রচুর পানি পান করুন।
  • দিনের কাজগুলো পরিকল্পনা মাফিক করুন, যাতে আপনি নিয়মিত বিশ্রাম নিতে পারেন। দীর্ঘ পথ হাঁটা এবং ভারি কিছু বহন করা থেকে বিরত থাকুন। ঠান্ডা জায়গায় থাকুন-অন্যথায় খুব দ্রুত আপনার শরীর পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে, যা আপনার বা আপনার বাচ্চার জন্য ভাল নয়।বাচ্চার নড়াচড়া ১২ঘন্টায় ১০-১২বার হচ্ছে কিনা খেয়াল করুন।

যেসব লক্ষণ দেখা দিলেই ডাক্তারের শরনাপন্ন হবেনঃ

  • যদি শিশুর নড়াচড়া অনুভব না করেন।
  • আপনার তলপেটে ব্যথা অনুভব করেন যেমনটা মাসিকের সময় হয়ে থাকে।
  • অনেক বিশ্রাম নেয়ার পর ও আপনি যদি ঘুম ঘুম ভাব বা দুর্বলতা অনুভব করেন।
  • যদি গা গুলিয়ে উঠে এবং বমি হতে থাকে।
  • যদি আপনি প্রচণ্ড মাথাব্যথা অনুভব করেন।
  • জ্বর জ্বর ভাব থাকে।
  • যদি আপনার ও গর্ভের শিশুর ওজন না বাড়ে।
  • যদি খুব ঘন ও কম প্রস্রাব হয়।বুঝতে হবে আপনি পানিশূন্যতায় ভুগছেন।
  • যদি বিকট গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হয় ।সেক্ষেত্রে ইউরিন ইনফেকশান এর সম্ভাবনা থাকে যা বাচ্চার জন্য  ক্ষতিকর।

পরিশেষে মনে রাখবেন গর্ভাবস্থায় আপনি শুধু আপনার নিজের জীবন নয় আরেকটি জীবনকেও ধারণ করছেন। কাজেই আপনার শিশুর ভাল মন্দের দায়ভার আপনার উপর।

আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিজের ও নিজের শিশুর জীবন বিপন্ন করে রোজা রাখতে যাবেন না। আল্লাহ এতটা নির্দয় বা অন্ধ বা অবুঝ না যে আপনার সমস্যা বুঝবেন না। কাজেই এমন বোকামী করা থেকে বিরত থাকুন।একটু সচেতনতা,সুস্থতা আর রুটিন মাফিক জীবন যাত্রা আপনাকে পবিত্র রমযানের রোজা রাখার সুযোগ করে দিবে।

Source: fairy land

Sharing is caring!

Comments are closed.