গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস বা প্রথম ট্রাইমেস্টার

আপনার বাচ্চা কিভাবে বৃদ্ধি পায়

আপনার গর্ভাবস্থা শুরু হয় যখন আপনার ডিম্বানু(ডিম্বক) পুরুষের শুক্রাণুর সাথে নিষিক্ত হয়। এই ডিম্বানু দুইটি কোষে বিভক্ত হয়।একটি ক্ষুদ্র কোষপিন্ডে পরিণত হওয়া পর্যন্ত এই বিভক্তি চলতে থাকে। তারপর এই কোষপিন্ড জরায়ুর নালী দিয়ে জরায়ুতে (জরায়ু) গিয়ে অবস্থান করে।তারপর এটি বৃদ্ধি পায় এবং পরিণত হয়।

শিশু- এই ধাপে একে ভ্রুণ বলে

গর্ভফুল/প্লাসেন্টা- এটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শিশুকে আপনার রক্ত থেকে পুষ্টি ও অক্সিজেন দ্বারা খাবার দেয়

আম্বিলিকাল কর্ড বা নাভিরজ্জু – এটি বাচ্চাকে প্লাসেন্টার সাথে সংযুক্ত করে (এটি একটি মহাসড়কের মতো যা বাচ্চার জন্য খাদ্য এবং অক্সিজেন নিয়ে যায় এবং বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়)

অ্যামনিওটিক স্যাক বা গর্ভথলি- ‘নরম পানির থলে’ যা বাচ্চাকে জরায়ুতে রক্ষা করে।

আমেরিকান কলেজ অফ অবসটেট্রিশিয়ান এন্ড গাইনেকোলজিস্ট (ACOG) এর মতে, গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে বাচ্চার হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের গঠন হওয়া শুরু হয়। এই সময়েই বেবির হাত, পা,  মস্তিষ্ক, স্নায়ুরজ্জু এবং স্নায়ুর গঠন ও শুরু হয়ে যায়।ভ্রূণের আকার তখন হয় একটি মটর দানার মত। দ্বিতীয় মাসে ভ্রূণের আকার বৃদ্ধি পেয়ে শিমের বিচির মত হয়। গোড়ালি, কব্জি, আঙ্গুল ও চোখের পাতা গঠিত হয়। হাড়ের প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে যৌনাঙ্গ এবং অন্তঃকর্ণেরও বিকাশ শুরু হয়।

দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে ভ্রনের ৮-১০ টি প্রধান অঙ্গ গঠিত হয়। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসেই গর্ভপাত হয় ও ভ্রূণের জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তাই এই সময়ে ক্ষতিকর কোন ঔষধ গ্রহণ  করা উচিৎ নয়।গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসে হাড় ও পেশীর বৃদ্ধি শুরু হয়। ভবিষ্যৎ দাঁতের জন্য ভিত্তি তৈরি হয় এবং হাত ও পায়ের আঙ্গুলের বৃদ্ধি হয়। এই সময়ে অন্ত্রের গঠন শুরু হয় এবং ভ্রূণের ত্বক প্রায় স্বচ্ছ  থাকে।

আপনার শেষ মাসিকের পর থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রুণ ১৩-১৬ মি.মি. লম্বা হয়। এটির হৃৎপিন্ড নড়তে শুরু করে।

আপনার কি কি হতে পারে? 

একজন নারীর শরীরে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। হরমোনের   পরিবর্তনের কারণে শরীরের প্রতিটা অঙ্গেই প্রভাব পড়ে। পরিবর্তনগুলো বাহ্যিকভাবে প্রকাশ না হলেও শরীরের অভ্যন্তরে হয়।  আপনাকে বাইরে থেকে দেখলে গর্ভবতী মনে হয় না, কিন্তু ভিতরে আপনার বাচ্চা দ্রুত বেড়ে উঠছে। এখন আপনি নিজের পাশাপাশি বাচ্চাকে দেখাশোনা করছেন। আপনার নিজের ও বাচ্চার সুস্বাস্থ্যের জন্য সঠিক খাবার খান এবং যে সকল জিনিষ বাচ্চার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক সেগুলো সম্পর্কে জানুন। গর্ভকালীন সেবা শুরু করার জন্য এখনই আপনার ধাত্রী অথবা ডাক্তারের সাথে দেখা করার সময় । শুরুতেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখলে:

  • গর্ভকালীন সমস্যা খুঁজতে ও প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে
  • গর্ভকালীন স্বাস্থ্য সেবাপ্রদানকারী সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে
  • গর্ভাবস্থায় ও প্রজননের/প্রসবের সময় কি প্রত্যাশা করেন তা খুঁজে দেখতে সাহায্য করে।

কিছু প্রত্যাশিত জিনিষ

অধিকাংশ মহিলা গর্ভাবস্থা স্বাভাবিকভাবেই কাটায় তবে আপনার শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে প্রথম তিনমাসে, এই পরিবর্তনগুলো আপনাকে অস্বস্তিদায়ক অনুভব করাতে পারে। কিছু প্রস্তুতিমূলক বিষয় আছে যা হল:

গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে বমিবমি ভাব স্বাভাবিক, কিন্তু এটি প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ঘটে না। যদিও এটি ‘সকালের অসুস্থতা’(মর্নিং সিকনেস) নামে অভিহিত, তথাপি গর্ভকালীন সময়ে দিনে বা রাতে যে কোন সময়ইএটি হতে পারে।এটি সাধারণত ছয় সপ্তাহ থেকে ১৪ সপ্তাহ পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, প্রাথমিক সপ্তাহে গর্ভাবস্থা বজায় রাখার জন্য শরীর কর্তৃক প্রস্তুতকৃত বাড়তি হরমোনের কারণে বমি ভাব হয়। ১২ থেকে ১৪ সপ্তাহে বাচ্চাকে ধারণ করার জন্য আপনার গর্ভের ফুল বা প্লাসেন্টা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। হরমোনের পরিমাণ কমার কারণে আপনি ভালো অনুভব করেন। কিছু গন্ধ আপনার বমিবমি ভাব সৃষ্টি করতে পারে যদিও পূর্বে এগুলো কোন প্রকার অস্বস্তি করতো না।

ক্লান্ত ও কম কর্মোদ্দম অনুভূত হওয়া  প্রথম ১২ সপ্তাহে স্বাভাবিক, কিন্তু এটি সাধারণত দীর্ঘ হয় না। আপনি সম্ভবত: ১৪ সপ্তাহের দিকে ভালো অনুভব করবেন (যদিও আপনি গর্ভকালীন সময়ের শেষের দিকে আবার ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন)।এই ক্লান্তির সময়টুকুতে যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিন – বিশেষ করে কাজের সময় এবং/বা আপনার আরো বাচ্চা থাকলে। এটা আপনাকে দুপুরের সময় বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ করে দেয়।এসময় আপনাকে হয়তো অন্য সময়ের চেয়ে আগেই রাতে বিছানায় যেতে হতে পারে। অধিক বিশ্রাম নেয়া অথবা রান্না ও অন্যান্য টুকিটাকি কাজে অন্যের সহায়তা নেয়া মানে আপনি যে পেরে উঠছেন না ঠিক তা না। এটিই আপনার শরীরের দরকার।

কখনো কখনো খিটখিটে অনুভব হলে আশ্চর্য হবেন না। আপনার শরীর ও জীবনে অনেক কিছু ঘটছে যা আপনার মেজাজকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রাথমিক মাসগুলোতে হরমোনের পরিবর্তন আপনাকে হতাশ করে তুলতে পারে। ক্লান্তি ও বমি ভাব আপনাকে খিটখিটে করতে পারে। আপনার জীবন পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে এটি বুঝতে পারা আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করে – বিশেষ করে আপনার সঙ্গীর সাথে যদি সমস্যা থাকে অথবা টাকার জন্য দুশ্চিন্তা থাকে। এসব অনুভূতি স্বাভাবিক। এগুলো নিজের মাঝে আবদ্ধ রাখবেন না – সঙ্গী বা বন্ধুর সাথে কথা বলুন। যদি অধিকাংশ সময় মন খারাপ থাকে বা দুশ্চিন্তা হয় তাহলে আপনার ধাত্রী বা ডাক্তারকে বলুন। এগুলো গর্ভকালীন বিষণ্ণতার লক্ষন হতে পারে।

যখন আপনি নতুন বাচ্চা প্রত্যাশা করেন তখন দুর্দশা, উদ্বেলিত বা ভিন্ন ও ভীতিকর চিন্তা মনে আসে এবং এটা স্বাভাবিক। যদি দুই সপ্তাহের বেশি বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তা অথবা নিজের বা বাচ্চার বিষয়ে চিন্তা , যতো শীঘ্র সম্ভব ধাত্রী বা ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। আপনার গর্ভকালীন বিষণ্ণতা বা এ সম্পর্কিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকতে পারে। যদি আপনার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অভিজ্ঞতা থাকে তবে তা পুনরাবর্তিত হওয়া স্বাভাবিক অথবা বাচ্চা জন্মের সময় ভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে, তাই এমন কাউকে খুঁজুন ও কথা বলুন যে আপনাকে যতো শীঘ্র সম্ভব সাহায্য করতে পারবে।

গর্ভাবস্থার প্রম তিন মাসে আপনাকে ঘন ঘন প্রস্রাব করতে হতে পারে। হরমোনের পরিবর্তন এবং মূত্রথলির উপর জরায়ুর চাপের কারণে তা ঘটে। প্রস্রাব করার সময় জ্বালাতন করলে বা ঘন ঘন প্রস্রাব হলে আপনার ডাক্তার বা ধাত্রীকে দেখান যেহেতু এগুলো একটি সংক্রমনের লক্ষণ।

আপনার স্তন বড় হতে থাকে এবং ব্যাথা ও নরম অনুভব করতে পারেন পর্যাপ্ত ভারবহন করতে পারে এমন ব্রা (বক্ষবন্ধনী) পরিধান করুন। গর্ভাবস্থার তিন মাস পরে আপনার মেটার্নিটি ব্রার (প্রসূতি ব্রা) প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আপনার কেনার সামর্থ্য না থাকলে দুশ্চিন্তার কিছু নাই। অন্তর্বাস ব্রা পরিধান না করাই শ্রেয়, যেহেতু এটি স্তন নালীর ক্ষতি করতে পারে। গর্ভাবস্থায় ব্রা-এর ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হলো এটি আরামদায়ক হবে, উপযুক্ত ভারবহন করে এবং স্তনের কোন অংশের উপর চাপ প্রয়োগ করে না। নতুন ব্রা কেনার সময় ভালভাবে আটকানোর ব্যবস্থা আছে কিনা দেখে নিন।  সামনে বন্ধনযোগ্য ব্রা পরবর্তীতে স্তন্যপান করাকে সহজ করে তোলে। যদি আপনার স্তনে রাতে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয় তাহলে স্পোর্টস্ব্রা বা ফিতাবিহীন পরার চেষ্টা করুন।

Source: fairy land

Sharing is caring!

Comments are closed.