নবজাতকের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ

ছোট শিশুদের ত্বক খুবই সংবেদনশীল। নানা কারণে শিশুদের ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। কিছু কিছু সমস্যা আমরাই সৃষ্টি করি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো তেমন বড় সমস্যা নয় এবং ভয় পাওয়ারও কিছু নেই।জন্মের পর পরই নবজাতকের কয়েকটি চর্মরোগ হতে পারে। শিশুর ত্বক খুব স্পর্শকাতর হওয়ায় এ রোগগুলো সম্পর্কে তাই ধারণা রাখা জরুরি। সঠিক পরিচর্যা ও চিকিৎসা হলে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

ত্বক হল শরীরের একটি অন্যতম অঙ্গ, যা নানা রকমের জীবাণুকে শরীরে ঢুকতে বাধা দেয়। তবে ত্বকের বেশীরভাগ অংশই যেহেতু উন্মুক্ত থাকে, তাই অনেকক্ষেত্রেই মারাত্মক ধরণের কিছু জীবাণুকে আটকানো ত্বকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তখন ত্বক নানা রকম সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পরে। আর এমনটা যদি শিশুদের সঙ্গে হয়, তাহলে তো কথাই নেই! সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। প্রসঙ্গত, যে যে চর্মরোগে নবজাতকেরা বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হয়ে থাকে, সেগুলি হল…

ন্যাপকিন র‍্যাশ বা ডায়াপার র‍্যাশ

সব শিশুই বার বার প্রস্রাব করে। কখনো বিছানায় কখনো কোলে থাকা অবস্থায়ই করে বলে অনেক মা বেশিরভাগ সময় ডায়াপার পরিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। ডায়াপার পড়ানোর সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও আছে। সেটাও কিন্তু মায়ের জানা থাকা প্রয়োজন। ডায়াপার প্রস্রাবে ভেজামাত্রই পরিবর্তন করা প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় পরিয়ে রাখলে এর মধ্যে জমে থাকা প্রস্রাবের ইউরিয়া ও পায়খানার জীবাণু মিলে এলার্জি সৃষ্টি করে এবং লক্ষ্য করলে দেখবেন ডায়াপার দ্বারা আচ্ছাদিত স্থানেই এই র‌্যাশ হয়ে থাকে। যেমন_ উরুতে বা (hip) গদিতে, উরুর ভাঁজযুক্ত স্থানে, কুঁচকি এবং (hip)গদির ভাঁজযুক্ত স্থানে।

এ স্থানগুলো দীর্ঘ সময় কাপড়ে বা ডায়াপারে আচ্ছাদিত থাকলে এর পাশাপাশি এক ধরনের ছত্রাকেরও আক্রমণ ঘটে; যেমন_ ক্যানডিডা। এরকম ছত্রাকের আক্রমণ ঘটেছে ধারণা করলে কাপড় সাময়িকভাবে বর্জন করে স্থানটিকে সম্পূর্ণ শুষ্ক রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ক্যানডিডার আক্রমণ ত্বক থেকে মুখ-জিহ্বাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। জিহ্বাতে এ ক্ষেত্রে সাদা সরের মতো আস্তরণ হতে দেখা যায়। শিশুরা এই ক্যানডিডা জাতীয় ছত্রাক দিয়ে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে গলার ভাঁজ থেকে শুরু করে পায়খানার রাস্তার আশপাশ কিংবা কুঁচকি পর্যন্ত যেকোনো ভাঁজযুক্ত ত্বক আক্রান্ত হয়ে থাকে।

সদ্যোজাত থেকে এক বছর বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে ন্যাপি র‍্যাশের সমস্যা সবথেকে বেশী দেখা যায়। ন্যাপি র‍্যাশ হওয়ার প্রধান কারণই হল ডায়াপার। ভেজা ডায়াপার পরিয়ে রাখলে শিশুদের এই ধরণের সমস্যা হয়ে থাকে। তাই খেয়াল করে ভেজা ডায়াপার বদলে ফেলে শিশুর ত্বক প্রতিনিয়ত শুকনো রাখাই উচিত।

শিশুর ব্রণ

খুব ছোট শিশু এমনকি নবজাতকের মুখেও পিম্পল বা ব্রণের মতো দেখা যায়। এটি তরুণ-তরুণীদের ব্রণের মতো নয়। অনেক সময় নতুন পরিবেশ, কখনও আবার মায়ের হরমোনের সমস্যা দেখা দিলেও তা শিশুর ত্বকে আক্রমণ করে বসে। কারণ শিশুরা মায়ের দুধের ওপরই বেশীরভাগ সময় নির্ভরশীল থাকে। এছাড়াও জন্মের সময়ই অনেক শিশুর ত্বকে অ্যাকনে বা ফুসকুড়ি দেখা যায়। সেক্ষেত্রে এই ধরণের সমস্যা জন্মের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেও দেখা যেতে পারে। শিশুদের গাল, পিঠ এবং কপালেই প্রধানত ব্রণ দেখা যায়। ব্রণ হওয়ার নানা কারণও আছে। যেমন, মায়ের দুধ পান করার থেকে হতে পারে, আবার খুব শক্ত এবং খসখসে কাপড় ব্যবহার করলেও হতে পারে। এমনকি খুব ক্ষার জাতীয় ডিটারজেন্ট বা সাবান দিয়ে শিশুদের জামাকাপড় ধুলেও তার থেকে এই ধরণের ত্বকের সমস্যা হতে পারে।

ঘামাচি (Prickly heat) 

ঘামাচির সঙ্গে আমাদের কম-বেশি পরিচিতি সবারই থাকার কথা। এটি একটি চর্মগ্রন্থির রোগ। গরমেই এটি হয়ে থাকে। একটি শিশুকে যদি বেশি রকম কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত করে রাখা হয় তাহলে এ রোগ বেশি পরিমাণে হতে দেখা যায়। অনেকের ধারণা, ছোট্ট শিশুকে জন্মের পরপরই গরম কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত করে রাখতে হবে, আবহাওয়া যতই গরম হোক না কেন? কথাটা মোটেই সঠিক নয়। গরম আবহাওয়ায় পাতলা কাপড় পরিধান করাতে হবে এবং ঘর যেন আবদ্ধ না হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ঘামাচি হলে ঠাণ্ডা হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এয়ারকুলারের মধ্যে থাকলে ঘামাচি হয় না। তা সম্ভব না হলে একটি পাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাতলা সুতির কাপড় পরাতে হবে এবং এতে নিয়ন্ত্রণ না হলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কারণ সময়মতো এর চিকিৎসা না হলে গায়ে ফোঁড়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

একজিমা

শিশুদের ত্বকের আরও একটি সমস্যা হল একজিমা। শরীরের যে কোনও অংশে, বিশেষত হাত, ভুরু, গলা, মুখ এবং হাঁটুর পিছনের দিকে এই ধরনের চর্ম রোগ হয়ে থাকে। একজিমা মূলত লালচে রঙের, শুষ্ক গোলাকার আকৃতি বিশিষ্ট হয়। বেশিরভাগ সময় চুলকানি দেখা যায় এক্সিমার ক্ষেত্রে। কিছুদিন পরে এগুলি থেকে পুঁজ বেরোতে থাকে, কখনও কখনও রক্তও বেরোয়।  কারো কারো ক্ষেত্রে আবার প্রচণ্ড চুলকানি হতে পারে। কখনো কখনো ইনফেকশন হওয়ার কারণে পুঁজ ও ঘা হতে পারে। যদিও শিশুরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনা আপনি এই ধরণের সমস্যা ঠিক হতে শুরু করে।শিশুদের ক্ষেত্রে শীতকালে খুব বেশি দেখা যায়। এটা মূলত বংশগত কারণের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের কারণগুলো যুক্ত হয়ে রোগটি তৈরি হয়।

চিকেন পক্স

শিশুদের ক্ষেত্রে চিকেন পক্স হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। মাথা যন্ত্রণা, জ্বর, খিদের অভাব, বমি বমি ভাব এবং গায়ে ব্যাথা ইত্যাদি উপসর্গ দিয়েই শুরু হয় চিকেন পক্স। শিশুরা তাদের কষ্ট বলে বোঝাতে পারে না বলে তাদের এই ধরণের সমস্যাগুলি বোঝা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে শিশুদের শরীর লক্ষ্য করে দেখতে হয় যে, কোনও জল ভরা ফুসকুড়ির মতো হয়েছে কিনা। এটি সাধারণত আকারে ছোট এবং লালচে হয়। এই ফুসকুড়িগুলো যন্ত্রণাদায়ক হয় না ঠিকই, কিন্তু চিকেন পক্স সেরে ওঠার সময় এগুলো চুলকানির সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গত, চিকেন পক্স মূলত ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। যদিও কয়েকদিনের মধ্যে সেরেও যায়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরণের সমস্যায় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া একান্ত জরুরি। এছাড়াও গায়ের চুলকানি ভাব কমাতে ক্যালামাইন লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে এই সময় শিশুকে সঠিক আহার এবং যত্নের মধ্যে রাখতে হয়।

ক্র্যাডেল ক্যাপ

ক্র্যাডেল ক্যাপ শিশুদের একটি খুব সাধারণ সমস্যা। এটি শিশুদের মাথাতেই হয়ে থাকে। ক্র্যাডেল ক্যাপ দেখতে একদম খুশকির মতো হয়। ক্র্যাডেল ক্যাপের ক্ষেত্রে মাথার ত্বক প্রথমে লালচে হয়ে যায়। তারপর হলদে বর্ণ ধারণ করে। এরপর সেটি শুষ্ক এবং শক্ত হয়ে প্রায় গুঁড়োতে পরিণত হয়। এই সময় প্রচুর মাত্রায় চুল ঝরে যায়।কখনো কখনো বাজে এক ধরনের গন্ধ হতে দেখা যায়।  মাথা ছাড়াও মুখ, নাক, গলা, পশ্চাৎদেশ এবং বগলেও এমন রোগ দেখা দিতে পারে। প্রসঙ্গত, এই ধরণের সমস্যা দূর করতে প্রতিদিন মাথা এবং চুল পরিষ্কার করতে হবে। সেই সঙ্গে নরম চিরুনির দ্বারা ধীরে ধীরে খুব সহজে ক্র্যাডেল ক্যাপ পরিষ্কার করতে হবে।এ ক্ষেত্রে তেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সাধারণত এ রোগ ছয় মাস বয়সের দিকে নিজ থেকেই ভালো হয়ে যায়।

হাম

ছোটবেলায় হাম হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। শিশুদের যে ধরণের ত্বকের সমস্যায় বেশি ভুগতে দেখা যায়, তার মধ্যে অন্যতম হল হাম। এই রোগের সূত্রপাত ঘটে খুব সাধারণ ভাবেই। যেমন, নাক দিয়ে জল পড়া, জ্বর, চোখ ফুলে যাওয়া এবং চোখের চারপাশে কালশিটে পড়া, সর্দি এবং মুখের ভেতরে সাদা রঙের ফুসকুড়ি হওয়া ইত্যাদি। এর কিছুদিন পরেই শরীরের বেশ কিছু অংশ, যেমন মুখ, গলা, কানের পিছনে লালচে দাগ বিশিষ্ট ছোট ছোট অসংখ্য অ্যাকনের মতো দেখা দেয়। ৫-৬ দিন থাকার পর এগুলি ধীরে ধীরে ঠিক হতে শুরু করে। যদিও এই সময় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অবশ্যই দরকার।

মিলিয়া

সদ্যজাতরা এই রোগে খুব ভুগে থাকে। এটিও বাকি ত্বকের সমস্যার মতোই হঠাৎ করে শুরু হয়। এক্ষেত্রে শিশুদের মুখমণ্ডলে সাদা রঙের অ্যাকনের মতো দানা দানা দেখা যায়। মিলিয়া গাল, কপাল, থুতনি, নাক এবং চোখের চারপাশে দেখা যায়। কিছু কিছু সময় এই অ্যাকনে গুলি আকারে বড় হতে শুরু করে এবং ভীষণই নরম হয়। তবে শিশুদের এই ধরণের ত্বকের সমস্যায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ ৬ সপ্তাহের মধ্যে এগুলো মিলিয়ে যেতে শুরু করে।

মাসি-পিসি

নবজাতকের জন্মের প্রথম সপ্তাহে সাধারণত দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে সারা শরীরে যে লাল লাল দানা দেখা যায়, তাকে গ্রামবাংলায় মাসি-পিসি বলা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর নাম ইরাইথেমা টক্সিকাম নিওনেটোরাম। এ ক্ষেত্রে শিশুর দেহে লাল লাল ভাব র‌্যাশের আকারে ফুটে ওঠে। সাধারণত মুখমণ্ডল, বক্ষপিঞ্জরের ত্বকসমূহ, হাত ও পায়ের অগ্রভাগের ত্বকসমূহে গুটি গুটি দানার আকারে বা র‌্যাশের আকারে ফুটে থাকে এবং সাথে কোনো রকম জ্বর বা অন্যরকম অসুস্থতা থাকে না। এবং সাধারণত দশম দিনে ভালো হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।

খোসপাঁচড়া  বা স্ক্যাবিস

এ রোগে অনেক শিশু আক্রান্ত হয়। অন্যের কারণে, যার দেহে সারকপটিস স্বেবিয়াই নামক জীবাণু আছে, সে যদি একটি শিশুকে আদর করে কিংবা তার বিছানায় শোয়, তা হলে এ রোগের সংক্রমণ খুব সহজে ঘটে থাকে। এ রোগে প্রথমে শিশুর শরীরে দারুণভাবে চুলকানি হতে দেখা যায়। তারপর একের পর এক পাঁচড়া হতে দেখা যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে এ থেকে অ্যাকজিমাও হতে দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, শুধু শিশুর চিকিৎসা হলেই রোগ সারানো যাবে না। শিশুর মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন অথবা যারা শিশুর পরিচর্যার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের সবার একসঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে। নয়তো এ রোগ সারিয়ে তোলা যাবে না।

জন্মদাগ

নবজাতকের শরীরে ১ থেকে ১০টি কালো বা রঙিন জন্মদাগ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সাধারণত মাতৃগর্ভে থাকার সময় বিভিন্ন চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণে এই দাগ পড়ে। এগুলো জন্মের পর পর বা কয়েক মাস পরও দেখা যেতে পারে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, তবে প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করে জেনে নিতে পারেন এটি সত্যি জন্মদাগ কি না। অনেক জন্মদাগ সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে আসে।

খোসার মতো ত্বক

ত্বক অনেক সময় হালকা পেঁয়াজের খোসার মতো উঠে আসে। একে বলে পিলিং। ত্বকের শুষ্কতার জন্য এটি হয়। নবজাতককে গোসল দেওয়ার পর তেল বা লোশন শরীরে লাগিয়ে দিলে এই শুষ্কতা অনেক কমে আসে। এতে বহিরাবরণ এবং নিম্নত্বক সুস্থ থাকে।

Source: fairy land

Sharing is caring!

Comments are closed.