শিশুর মস্তিষ্কে পানি জমা (বা হাইড্রোক্যাফালাস) ডা. মো. জাহেদ হোসেন।

মস্তিষ্ক সিএসএফ নামের যে তরলের মধ্যে ভাসতে থাকে, তার পরিমাণ বেড়ে যায়, তবে মাথার আকৃতি বড় হতে পারে, চোখের দৃষ্টি কমে গিয়ে অন্ধত্ব হতে পারে, রোগীর স্মরণশক্তি ভীষণভাবে কমে যেতে পারে, এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের নিউরোট্রমা বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. জাহেদ হোসেন 

মাথার ভেতরে প্রায় দেড় কেজি ওজনের মগজ নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি; কিন্তু তা অনুভব করতে পারি না। কারণ মাথার ভেতরে মগজ বা মস্তিষ্ক পানির মতো এক ধরনের তরলে ভাসছে; যার ফলে মগজের ওজন পানির প্লবতা সূত্র অনুযায়ী কমে গিয়ে হালকা অনুভূতি দিচ্ছে। মাথার ভেতরের এই পানিকে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বা সিএসএফ বলে। সিএসএফ শুধু মগজের ওজনই কমায় না, এর ফলে মাথা নড়াচড়ার সময় ব্রেন আঘাত পাওয়া থেকেও রক্ষা পায়। ব্রেন খুবই সংবেদনশীল ও নরম টিস্যু, আবার মাথার খুলির ভেতরটা মসৃণ নয়। খুবই অসমতল বা এবড়োখেবড়ো। সিএসএফ না থাকলে ব্রেন খুব সহজে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারত। আবার সিএসএফ ব্রেনের রেচনপ্রক্রিয়ায়ও সাহায্য করে।

মাথার ভেতরের এই পানি বা সিএসএফ যেমন ব্রেনের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়, তেমনি মাথার ভেতরে এই তরল বেশি হলেও অসুবিধা। কারণ মাথার ভেতরের আয়তন নির্দিষ্ট, খুলির কারণে এই আকার বাড়ার সুযোগ নেই। খুলির ভেতরে মগজ বা ব্রেন, সিএসএফ এবং রক্ত একটি নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে থাকতে হয়। এর কোনো একটা বাড়লে অন্যটাকে কমতে হবে। ব্রেনের পরিমাণ বাড়লে সিএসএফ কিংবা রক্তের পরিমাণ কমতে হবে। আবার সিএসএফের পরিমাণ বেড়ে গেলে ব্রেনে রক্তের পরিমাণ কমে যাবে। আবার ব্রেনের আয়তন কমাতে হলে এর ওপর চাপ তৈরি হবে, তাহলে ব্রেন ঠিকমতো কাজ করতে পারবে না। আবার রক্তের পরিমাণ কমে গেলে পুষ্টি ও অক্সিজেনের অভাবে ব্রেন কাজ করতে পারে না।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মাথার খুলির ভেতরে প্রায় ১৫০ মিলি পানি বা সিএসএফ থাকে। এই সিএসএফ ব্রেনের বাইরে বা ব্রেনের ভেতরে ভেন্ট্রিকলের মধ্যে থাকে এবং এটা তৈরি হয় ভেন্ট্রিকলের ভেতরের করয়েড প্লেক্সাস নামের একটি অংশ থেকে। সিএসএফ কিন্তু রক্ত দিয়ে শোষিত হয়। এভাবে সারা দিনে প্রায় ৫০০ মিলি

সিএসএফ তৈরি হয় এবং প্রায় তিনবার সম্পূর্ণভাবে বদল হয়। মাথার পানি জমার কারণ

মাথার পানি জমা বা হাইড্রোক্যাফালাসের কারণগুলোকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়।

জন্মগত ত্রুটি : এগুলো সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন—অ্যাকুইডাক্টাল স্টেনোসিস, চিয়ারি ম্যালফরমেশন, ড্যান্ডি ওয়াকার ম্যালফরমেশন, স্পিনা বাইফিডা ইত্যাদি। এগুলো সাধারণত শিশুর মাথার ভেতরে সিএসএফ বা পানি চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ফলে মাথায় পানি জমে যায়।

জন্ম-পরবর্তী কারণ : এসব কারণ জন্মের পর বিভিন্ন সময়ে শিশু বা বড়দের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। যেমন—মেনিনজাইটিস (মাথার ভেতরের মস্তিষ্কের পর্দায় প্রদাহ), হিমোরেজ বা রক্তক্ষরণ, মাথায় আঘাত পাওয়া, ব্রেন টিউমার ইত্যাদি। এসব কারণেও মাথার ভেতরে পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয় বা মস্তিষ্কের পানি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি বা সিএসএফ তৈরি হয়।

আবার মাথার ভেতরে সিএসএফের চলাচলের ওপর ভিত্তি করে হাইড্রোক্যাফালাস দুই ধরনের হতে পারে।

প্রতিবন্ধকতাবিহীন বা কমিউনিকেটিং : এ ক্ষেত্রে সিএসএফ চলাচলের পথে কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত সিএসএফ বেশি তৈরি হয় অথবা সিএসএফ রক্ত দিয়ে কম শোষিত হয়।

প্রতিবন্ধক বা নন-কমিউনিকেটিং বা অবস্ট্রাক্টিভ : এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ভেতরে সিএসএফ চলাচলের পথে কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা বা বাধা আছে, যাতে সিএসএফ যেখানে গেলে রক্ত দিয়ে শোষিত হয়, সেখানে পৌঁছতে পারে না।

মাথায় পানি জমে গেলে মস্তিষ্কের ভেতরে যে প্রকোষ্ঠ বা ভেন্ট্রিকল আছে, তা আস্তে আস্তে ফুলে যায় এবং মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এতে মাথার খুলির ভেতরে চাপ বেড়ে যায়। মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়। মস্তিষ্কের ভেতরে চাপ বেড়ে গেলে চোখের স্নায়ুর প্রান্ত ফুলে যায় এবং মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে, এমনকি একসময় অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

নবজাতক ও শিশুদের ক্ষেত্রে যাদের মাথার খুলির জোড়াগুলো শক্ত হয়ে লেগে যায়নি, তাদের ক্ষেত্রে মাথার ভেতরে পানি জমতে থাকলে মাথা বড় হয়ে যেতে থাকে এবং শিশু ওপরের দিকে তাকাতে পারে না।

উপসর্গ

মাথায় পানি জমা রোগের উপসর্গ রোগীর বয়সভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আবার সিএসএফ বৃদ্ধি পাওয়ার হারের ওপরও উপসর্গ নির্ভর করে।

নবজাতক ও এক বছরের নিচে বাচ্চাদের মাথায় পানি জমলে

  • ► মাথা বড় হতে থাকে
  • ► বাচ্চা মাথা তুলতে পারে না
  • ► মাথার শিরাগুলো ফুলে থাকে
  • ► বাচ্চা ওপরের দিকে তাকাতে পারে না, নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে
  • ► খুব কান্নাকাটি করে
  • ► খেতে চায় না
  • ► তালুর সামনের দিকে ফুলে থাকে
  • ► কখনো কখনো খিঁচুনি হয়।
  • ►বাচ্চার বয়স এক বছরের বেশি হলে
  • ► মাথা ব্যথার কথা বলে
  • ► কান্নাকাটি করে, খেতে চায় না
  • ► খুব খিটখিটে হয়
  • ► বমি হয়
  • ► মাথা বড় হতে থাকে
  • ► মাথার খুলির হাড়গুলো জোড়া লাগে না, ফাঁক থাকে
  • ► বাচ্চা প্রস্রাব ধরে রাখতে পারে না
  • ► কোনো কিছু সহজে মনে রাখতে পারে না
  • ► নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে, ওপরের দিকে তাকাতে পারে না
  • ► কখনো কখনো খিঁচুনি হতে পারে
  • ► দৃষ্টিশক্তি একটু একটু করে কমতে থাকে, অনেকের চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

বড়দের ক্ষেত্রে—

  • ► তীব্র মাথা ব্যথা হয়
  • ► বমি হয়
  • ► দ্রুত চোখের দৃষ্টি চলে যায়
  • ► খিঁচুনি হয়
  • ► ঘন ঘন অজ্ঞান হয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বয়স্ক লোকদের ক্ষেত্রে মাথায় পানি জমে; কিন্তু মাথার ভেতরে চাপ খুব বেশি বাড়ে না। এর কারণ বয়স্ক লোকদের মস্তিষ্ক কিছুটা ছোট হয়ে যায়, যা সেরিব্রাল এট্রফি নামে পরিচিত। এ ধরনের হাইড্রোক্যাফালাসকে নরমাল প্রেসার হাইড্রোক্যাফালাস বলে। এতে আক্রান্ত রোগীরা প্রস্রাব ধরে রাখতে পারে না, হাঁটতে অসুবিধা বোধ করে এবং স্মরণশক্তি কমে যায়।

মাথার ভেতরে সিএসএফ বৃদ্ধির হারের ওপরও উপসর্গ নির্ভর করে। যেসব ক্ষেত্রে পানি খুব দ্রুত জমে যায়, সেসব ক্ষেত্রে রোগী তীব্র মাথা ব্যথা নিয়ে আসে, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং রোগী মারা যায়। যেসব রোগীর মাথায় পানি জমার হার অল্প অর্থাৎ আস্তে আস্তে একটু একটু করে পানি জমে, তারা দ্রুত অজ্ঞান হয় না; কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হারায় তাড়াতাড়ি।

রোগ নির্ণয়

সাধারণত রোগীকে পরীক্ষা করে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে রোগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু নিশ্চিত হতে হলে কিছু পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। এক বছরের ছোট শিশুদের মাথার আল্ট্রাসনোগ্রাম বা সিটিস্ক্যান বা এমআরআই পরীক্ষা করে নির্ণয় করা যায়। তবে বড়দের ক্ষেত্রে আল্ট্রাসনোগ্রাম করা যায় না। মাথার সিটিস্ক্যান বা এমআরআই পরীক্ষা করেই রোগ নির্ণয় করতে হয়।

চিকিৎসা

মাথার সিএসএফ জমা বা হাইড্রোক্যাফালাস হলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা করতে হবে নতুবা মস্তিষ্কের ওপর চাপ বাড়তে থাকবে, এটি কাজ করতে পারবে না। শিশুদের মাথা বড় হয়ে যায় এবং বুদ্ধি বিকাশ হয় না।

মাথার পানি জমার কারণ সব সময় দূর করা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারণ দূর করা যায়। যেমন টিউমার হয়ে যদি তরল চলাচলের পথ বন্ধ হয়, তবে তা অপসারণ করলে রোগটি সেরে যায়। কিন্তু বেশির ভাগ জন্মগত ত্রুটি, যা পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, তা দূর করা যায় না। মাথার ভেতরে পানি চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হলে বা পানি ঠিকমতো রক্তে শোষণ হতে না পারলে সিএসএফ বিকল্প পথে চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে মাথার ভেতরে পানি চলাচলের পথ বন্ধ থাকলে, বিকল্প একটি পথ তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে। এ অপারেশন এখন এন্ডোসকোপ দিয়ে করা হয়, এর নাম ইটিভি বা এন্ডোস্কোপিক থার্ড ভেন্ট্রিকুলেস্টোমি। রোগীর জন্য এটি খুব ভালো পদ্ধতি। এতে রোগী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশি। তবে সব ক্ষেত্রে এ অপারেশন করা যায় না। অনেক সময় শান্ট অপারেশন করা হয়। এতে ইনফেকশনের ঝুঁকি একটু বেশি থাকে। সূত্রঃkalerkantho

Sharing is caring!

Comments are closed.